হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –১২

বাদশাহ নামদার পর্ব –২০

শের খাঁ’র উজির বললেন, শক্র  সম্পর্কে এমন প্রশংসাসূচক বাক্য দুর্বলতার নামান্তর ।

শের খাঁ বললেন, আমি অবশ্যই এই মানুষটির প্রতি দুর্বল । আমি সম্রাটের লেখা একটি কবিতা পাঠ করছি ।

পাঠ শেষ হওয়ামাত্র আপনারা বলবেন, মারহাবা ।

অশ্ব অশ্বারোহীর বন্ধু নয় ।

যেমন বন্ধু নয় বায়ু, মেঘমালার ।

বন্ধু হবে এমন যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হবে না ।

দু’জনই থাকবে দু’জনের কাছে অদৃশ্য ।

দৃশ্যমান থাকবে তাদের ভালোবাসা ।

শের খাঁ’র উজির নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন, মারহাবা ।

হিন্দুস্থানি এক নগ্নগাত্র জাদুকর এসেছে সম্রাটকে ভোজবাজি দেখাতে । তার কোমরের কাছে মালকোঁচা দিয়ে পরা নোংরা ধুতি । মাথায় বিশাল সাদা পাগড়ি । পাগড়ি পরিষ্কার, ঝকঝক করছে । সে কৃশকায়, গাত্রবর্ণ পাতিলের তলার মতো কালো । ভোজওয়ালার সঙ্গে তার কন্যা । বয়স চার-পাঁচ । সেও নগ্নগাত্র। লাল টুকটুকে প্যান্ট পরেছে । মেয়েটির চোখ মায়াকাড়া । সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে । একবারের জন্যেও দুষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না । তার দৃষ্টিতে ভয় এবং বিস্ময় ।

সম্রাট বসেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে । পরিবারের বাইরে আছে অম্বা, কিছু পরিচারিকা এবং একদল খোজা প্রহরী । সম্রাট বললেন, খেলা দেখাও ।

বাজিকর সম্রাটকে কুর্নিশ করল । এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তার দুই হাতই খালি, এখন তার ডান হাতে একটা আমের আঁটি দেখা গেল। সে আমের আঁটি মাটিতে পুঁতে দিল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাটি ফুঁড়ে আমগাছ বের হতে শুরু করল । সম্রাট বললেন, সোবহানাল্লাহ্।

বাদশাহ নামদার পর্ব –১২

বাজিকর গাছের উপর দিয়ে একবার হাত বুলিয়ে নিতেই দেখা গেল গাছে তিনটা পাকা আম ঝুলছে । বাজিকর আম তিনটা ছিঁড়ে সম্রাটের সামনে রেখে আবারও কুর্নিশ করল । সম্রাট বললেন, মারহাবা । বলেই বিস্ময়ে অভিভূত হলেন-যেখানে আমগাছ ছিল সেখানে গাছ নেই । কুণ্ডলী পাকিয়ে বিষধর গোখরো সাপ বসে আছে । সাপ ফণা তুলেছে । ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে ।

মহিলারা অস্ফুট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলেন । জাদুকর মাথার পাগড়ি খুলে সাপ ঢেকে দিল । বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিতেই দেখা গেল পাগড়ির ভেতর কোনো সাপ নেই । সাপের পরম শক্র  লালচোখা বেজি বসে আছে । এবার সবাই একসঙ্গে বলল, মারহাবা ।

সম্রাট বললেন, তুমি কি আমার সঙ্গে দিল্লী যাবে ? আমি তোমাকে জায়গির দেব । বিশেষ বিশেষ উৎসবে তুমি তোমার খেলা দেখাবে । (সম্রাট কথা বললেন দোভাষীর মাধ্যমে, তিনি হিন্দুস্থানি জানেন না ।) জাদুকর বলল, না ।

না কেন ?

নদী অতিক্রম করা আমার জন্যে নিষেধ ।

নিষেধ কে করেছেন ?

আমার গুরু ।

জাদুকর গুরুর উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করল। সম্রাট বললেন, জাদু দেখানোর সময় তুমি মন্ত্রপাঠ করেছ । মন্ত্র বলে কি কিছু আছে ?

আছে ।

সবচেয়ে কঠিন মন্ত্র কোনটি ?

শূন্যে ভাসা মন্ত্র । এই মন্ত্র পড়লে শূন্যে ভাসা যায় ।

তুমি শূন্যে ভাসতে পার ?

আমি পারি না, আমার গুরু পারেন ।

জাদুকর আবারও গুরুর উদ্দেশে দুই হাত জোড় করল ।

তুমি কী পার?

বাদশাহ নামদার পর্ব –১২

আমি পানির উপর হাঁটতে পারি । তবে নদীর পারি না, দিঘির শান্ত পানি । নদীর পানির উপর হাঁটতে পারি । তবে নদীতে পারি না, দিঘির শান্ত পানি । নদীর পানির উপর দিয়ে হাঁটা আমার গুরুর নিষেধ ।

তুমি কি পানির উপর দিয়ে হাঁটার জাদু আমাকে দেখাতে পারবে ?

পারব ।

চিকিৎসক এবং সম্রাট এই দু’জনের কাছে সর্ব অবস্থায় সত্যি কথা বলতে হয় । তুমি সত্যি করে বলো, পানির উপর দিয়ে হাঁটার কি কোনো কৌশল আছে, না শুধুই মন্ত্র ?

কৌশল আছে । তুমি কি এই কৌশল আমাকে শিখাবে ?

সম্রাট রাজ্য শাসন করবেন । ভোজবাজি কেন শিখবেন ?

তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পার । আমি তোমার ভোজবাজি দেখে মুগ্ধ হয়েছি । তুমি আমার কাছে কী চাও বলো ।

আমি ভগবান ছাড়া কারও কাছে কিছু চাই না । আপনি আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন এতেই আমি খুশি । সম্রাটকে খুশি করতে পারা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার । আমি ভাগ্যবান ।

সম্রাট তাঁর কন্যা আকিকা বেগমকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন । আকিকা ছুটে এল ।

ভোজবাজির খেলা কেমন লাগল মা ?

খুব ভালো লাগল বাবা ।

এই জাদুকর আমাকে খুশি করেছে, আমি তাকে খুশি করতে চাই । কী উপহার পেলে সে খুশি এবং বিস্মিত হবে ?

বাবা, আপনি তাকে একটা হাতি উপহার দিন ।

হাতি?

হ্যাঁ হাতি । উপহার হিসেবে সে হাতি পাবে এটা কখনো কল্পনা করে নি । আপনার উপহার তার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে । তোমার সঙ্গে যে হিন্দুস্থানি মেয়েটি আছে সে কেমন আছে ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –১২

খুব ভালো আছে । আনন্দে আছে ।

তার নাম যেন কী ?

তার নাম অম্বা ।

সে কি তার আত্মীয়স্বজনের কাছে ফেরত যেতে চায় ?

না । আত্মীয়স্বজনরা তাকে ফেরত নেবে না । সে বাজি জীবন আমার সঙ্গে থাকবে । বাবা, আপনি কি জানেন আমরা দু’জন এক বিছানায় ঘুমাই

জানতাম না ।

এখন জানলাম । আপনি কি রাগ করেছেন ?

আমি আমার আদরের আকিকা বেগমের উপর কখনো রাগ করব না ।

আমি যদি কোনো অন্যায় করি তারপরেও না ?

তারপরেও না । তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ ?

করেছি । বড় অন্যায় করেছি ।

অন্যায়টা কি বলবে ?

না ।

আচ্ছা যাও । তোমার বড় অন্যায় ক্ষমা করা হলো ।

সম্রাটের নির্দেশে হিন্দুস্থানি জাদুকরকে একটা হাতি উপহার হিসেবে দেওয়া হলো । হতভম্ব জাদুকর এবং তার মেয়েকে হাতির পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো । বাচ্চা মেয়েটি আতঙ্কে অস্থির হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকল ।*

*হাতির পিঠে হিন্দুস্থানি জাদুকর এবং তার কন্যার মোঘল রীতিতে আঁকা একটি পেইন্টিং ব্রিটিশ জাদুঘরে রক্ষিত আছে ।

শের খাঁ তার সমরবিশারদদের নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেছেন । সমরবিশারদদের চারজনের মধ্যে আছে দুই পুত্র জালাল খাঁ, সাইফ খাঁ এবং দুই সেনাপতি ।

শের খাঁ বললেন, যুদ্ধ শুরুর আগে শক্রর সরল এবং দুর্বল দিকগুলি খুঁজে বের করতে হবে । সম্রাট হুমায়ূনের সবল এবং দুর্বল দিক কী ?

জালাল খাঁ বললেন, সম্রাট হুমায়ূন ভীরু মানুষ, এটাই তার দুর্বল দিক । তাঁর কামানবাহিনী হলো তাঁর সবল দিক ।

পুত্র! তুমি ভুল বললে । হুমায়ূন অসম্ভব সাহসী একজন মানুষ । আমোদপ্রিয়, তবে সাহসী । আর তাঁর বিশাল কামানবাহিনী তাঁর সবচেয়ে ‍দুর্বল দিক ।

বাদশাহ নামদার পর্ব –১২

কেন ?

কামানবহর নিয়ে শক্রর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না । এত কামান কীভাবে দ্রুত টেনে নেবে? কামানবহরকে স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকতে হয় । বিশাল কামানবহর নিয়ে আক্রমণ করা যায় না । শক্র প্রতিরোধ করা যায় ।

জালাল খাঁ বললেন, আমি এই ভাবে ভাবি নি । আপনার কথা সত্য ।

তবে সম্রাট হুমায়ূন যে কাপুরুষ এই কথাটি সত্য ।

তুমি মনে হয় পানিপথের যুদ্ধের কথা ভুলে গেছ । পানিপথে সম্রাট বাবরের ডানবাহুর দায়িত্বে ছিলেন হুমায়ূন । তিনি অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছেন । বাহাদুর শাহ’র হাত থেকে তিনি চিতোর কীভাবে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাও সম্ভবত তোমার মনে নেই । সম্রাট হুমায়ূন সাহসী, কিন্তু খেয়ালি মানুষ । তাঁর চরিত্রের খেয়ালি অংশই হলো তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা । আমরা তাঁর এই দুর্বলতাকেই ব্যবহার করব ।

কীভাবে ?

শের খাঁ শান্ত গলায় বললেন, নানান খেয়ালে তিনি যেন সময় পার করতে পারেন আমরা সেই চেষ্টা করব । জাদুবিদ্যার একটা প্রাচীন বই জোগাড় করেছি । সেই বই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে । বইটি প্রাচীন কোনো অপ্রচলিত ভাষায় লেখা । সম্রাটের সময় যাবে বইটির ভাষা উদ্ধার করতে । আমি ত্রিপুরা রাজ্য থেকে একটা হাতির বাচ্চা জোগাড় করেছি । হাতির বাচ্চার বিশেষত্ব হচ্ছে-প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সে দু’টা শুঁড় নিয়ে জন্মেছে । সম্রাট দুই শুঁড়ের হাতির বাচ্চা নিয়েও সময় কাটাবেন । আমি কীভাবে শক্তি সংগ্রহ করছি তা তাঁর চোখ এড়িয়ে যাবে ।

 

Read more

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –১৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *