কুয়ার পানি নদীর পানির মতাে গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে–মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনাে ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা–ধরা প্রাচীন কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতাে চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনাে দৃশ্য।
সুধাকান্তবাবু? ‘বলুন।
রান্নার কত দূর? দেরি হবে না।” একা–একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?” ‘না, অভ্যেস হয়ে গেছে।‘
বাসায় ফিরে আপনি করেন কী?
তেমন কিছু করি না। চুপচাপ বসে থাকি। ‘ভয় লাগে না? সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।
খাবার আয়ােজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নি। একটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধ—খেতে একটু টক–টক। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়া। ডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নি। এমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে –ই আমার জানা ছিল না। মুগের ডাল। ডালে ঘি দেওয়াতে অপুর্ব গন্ধ!
বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)
আমি বললাম, ‘সুধাকান্তবাবুএত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালাে লেগেছে। রুচি রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই।
আমি চমৎকৃত হলাম। লােকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা।
সুধাকান্তবাবু উঠোনে পাটি পেতে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট হাতে সেখানে বসলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। সুধাকান্তবাবুকে অবশ্যি খুব আলাপী লােক বলে মনে হচ্ছে না। এই যে দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আছি, তিনি এর মধ্যে আমার নাম জানতে চান নি। আমি কী করি তাও জানতে চান নি। আমি এই মানুষটির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ বােধ করছি, কিন্তু এই লােকটা আমার প্রতি কোনাে আগ্রহ বােধ করছে না। অথচ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মাস্টারি করে, তারা কথা বলতে খুব পছন্দ করে। অকারণেই কথা বলে।।
প্রায় মিনিট পনের আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সুধাকান্তবাবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন একা–একা আমি এই বাড়িতে থাকতে ভয় পাই কি না, তাই না?‘
আমি বললাম, “হ্যা, তাই।‘
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ভয় পাই। প্রায় রাতেই ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকি। ঘরের ভেতর আগুন করে রাখি। হারিকেন জ্বালান থাকে। ওরা আগুন ভয় পায়। আগুন থাকলে কাছে আসে না।‘
বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কারা? তিনি জবাব দিলেন না। আমি বললাম, আপনি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন?
হ্যা। আমি মনে–মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। পৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছে— এই বৃদ্ধ তা বােধহয় জানে না। চাঁদের পিঠে মানুষের জুতাের ছাপ পড়েছে, ভাইকিং উপগ্রহ নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে, ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহস্পতির কিনারা ঘেঁষে, আর এই অঙ্কের শিক্ষক ভূতের ভয়ে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখছে। কারণ, অশরীরীরা আগুন ভয় পায়।
আমি বললাম, আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনাে?
‘ওদের পায়ের শব্দ পান?
তাও না। তাহলে ? ‘বুঝতে পারি।‘ ‘বুঝতে পারেন? ‘জ্বি। আপনি যখন আছেন, আপনিও বুঝবেন। ‘ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে পাব, তাই বলছেন? ‘, তবে ওদের না, এক জন শুধু আসে।‘
‘তাও ভালাে যে এক জন আসে। আমি ভেবেছিলাম দলবল নিয়ে বােধহয় চলে আসে। নাচ গান হৈ–হল্লা করে।‘
‘আপনি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছেন না?
‘ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বাস করছি না। অবশ্যি এই মুহূর্তে আমার গা ছমছম করছে। কারণ, আপনার পরিবেশটা ভৌতিক।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ওরা কিন্তু আছে।‘
আমি চুপ করে রইলাম। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে তর্ক করার কোনাে অর্থ হয় না। থাকলে থাকুক।
‘আমার কাছে যে আসে, সে একটা মেয়ে।
বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)
তাই নাকি? ‘ক্সি, এগার–বার বছর বয়স। ‘বুঝলেন কী করে তার বয়স এগার–বার? আপনাকে বলেছে? ‘জ্বি–না। অনুমান করে বলছি।‘ ‘তার নাম কি? নাম জানেন? “জ্বি–না। ‘সে এসে কী করে?
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘মেয়েটি যে আসছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার কি আর কিছু করার প্রয়ােজন আছে?
আমি চুপ করে গেলাম। আসলেই তাে, অশরীরী এক বালিকার উপস্থিতিই তাে যথেষ্ট। সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘আপনি নিজেও হয়তাে দেখতে পারবেন। আমি চমকে উঠলাম। ভদ্রলােক সহজ স্বরে বললেন, আমি ছাড়াও অনেকে দেখেছে।
সুধাকান্তবাবু ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গে–সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। উঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হাে–হাে করে কে যেন হেসে উঠল। সুধাকান্তবাবু পাশে না থাকলে অজ্ঞানই হয়ে যেতাম। আমি তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠলাম, কে, কে?
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ওটা কিছু না। আমি ভয়–জড়ানাে গলায় বললাম, ‘কিছু না মানে?
ওটা খাটাশ। মানুষের মতাে শব্দ করে হাসে। বলেন কী! খাটাশের নাম তাে এই প্রথম শুনলাম। এ তাে ভূতের বাবা বলে মনে
হচ্ছে! এখনাে আমার গা কাঁপছে।
‘জল খান। জল খেলে ভয়টা কমবে।
বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)
সুধাকান্তবাবু কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। খাটাশ নামক জন্তুটি আরেক বার রক্ত হিম–কা হাসি হাসল। সুধাকান্তবাবু যদি কিছু না বলতেন তাহলে ভূতের হাসি শুনেছি, এই ধারণা সারা জীবন আমার মনের মধ্যে থাকত।
লােকটার প্রতি এই প্রথম আমার খানিকটা আস্থা হল। আজগুবি গল্প বলে ভয় দেখান এই লােকের ইচ্ছা নয় বলেই মনে হল। এ–রকম ইচ্ছা থাকলে, এই ভয়ংকর হাসির কারণ সম্পর্কে সে চুপ করে থাকত।
Read more