বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

বৃহন্নলা-পর্ব-৫

কুয়ার পানি নদীর পানির মতাে গরম নয়, খুব ঠাণ্ডাপানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেলসারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতাসব ধুয়েমুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগলতা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুতপুরনাে ধরনের একটা বাড়িঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলাধরা প্রাচীন কুয়াআকাশে পরিষ্কার চাঁদকামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধএক ঋষির মতাে চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেনযেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনাে দৃশ্য। 

সুধাকান্তবাবু? বলুন। 

রান্নার কত দূর? দেরি হবে নাএকাএকা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?না, অভ্যেস হয়ে গেছে‘ 

বাসায় ফিরে আপনি করেন কী

তেমন কিছু করি নাচুপচাপ বসে থাকিভয় লাগে না? সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। 

খাবার আয়ােজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নিএকটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধখেতে একটু টকটকবেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়াডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নিএমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে আমার জানা ছিল নামুগের ডালডালে ঘি দেওয়াতে অপুর্ব গন্ধ

বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)

আমি বললাম, সুধাকান্তবাবুএত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নিদীর্ঘদিন মনে থাকবে। 

সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালাে লেগেছেরুচি রহস্য ক্ষুধায়যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই। 

আমি চমৎকৃত হলামলােকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা। 

সুধাকান্তবাবু উঠোনে পাটি পেতে দিলেনখাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট হাতে সেখানে বসলামকিছুক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারেসুধাকান্তবাবুকে অবশ্যি খুব আলাপী লােক বলে মনে হচ্ছে নাএই যে দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আছি, তিনি এর মধ্যে আমার নাম জানতে চান নিআমি কী করি তাও জানতে চান নিআমি এই মানুষটির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ বােধ করছি, কিন্তু এই লােকটা আমার প্রতি কোনাে আগ্রহ বােধ করছে নাঅথচ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মাস্টারি করে, তারা কথা বলতে খুব পছন্দ করেঅকারণেই কথা বলে। 

প্রায় মিনিট পনের আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সুধাকান্তবাবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন একাএকা আমি এই বাড়িতে থাকতে ভয় পাই কি না, তাই না?‘ 

আমি বললাম, হ্যা, তাই‘ 

সুধাকান্তবাবু বললেন, ভয় পাইপ্রায় রাতেই ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকিঘরের ভেতর আগুন করে রাখিহারিকেন জ্বালান থাকেওরা আগুন ভয় পায়আগুন থাকলে কাছে আসে না‘ 

বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)

আমি অবাক হয়ে বললাম, কারা? তিনি জবাব দিলেন নাআমি বললাম, আপনি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন

হ্যাআমি মনেমনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললামপৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছেএই বৃদ্ধ তা বােধহয় জানে নাচাঁদের পিঠে মানুষের জুতাের ছাপ পড়েছে, ভাইকিং উপগ্রহ নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে, ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহস্পতির কিনারা ঘেঁষে, আর এই অঙ্কের শিক্ষক ভূতের ভয়ে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখছেকারণ, অশরীরীরা আগুন ভয় পায়

আমি বললাম, আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনাে

ওদের পায়ের শব্দ পান

তাও নাতাহলে ? বুঝতে পারিবুঝতে পারেন? জ্বিআপনি যখন আছেন, আপনিও বুঝবেনওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে পাব, তাই বলছেন? , তবে ওদের না, এক জন শুধু আসে‘ 

তাও ভালাে যে এক জন আসে। আমি ভেবেছিলাম দলবল নিয়ে বােধহয় চলে আসেনাচ গান হৈহল্লা করে‘ 

আপনি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছেন না?

ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বাস করছি নাঅবশ্যি এই মুহূর্তে আমার গা ছমছম করছে। কারণ, আপনার পরিবেশটা ভৌতিক। 

সুধাকান্তবাবু বললেন, ওরা কিন্তু আছে‘ 

আমি চুপ করে রইলামএই বৃদ্ধের সঙ্গে ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে তর্ক করার কোনাে অর্থ হয় নাথাকলে থাকুক। 

আমার কাছে যে আসে, সে একটা মেয়ে। 

বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)

তাই নাকি? ক্সি, এগারবার বছর বয়সবুঝলেন কী করে তার বয়স এগারবার? আপনাকে বলেছে? জ্বিনাঅনুমান করে বলছিতার নাম কি? নাম জানেন? জ্বিনাসে এসে কী করে

সুধাকান্তবাবু বললেন, মেয়েটি যে আসছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার কি আর কিছু করার প্রয়ােজন আছে

আমি চুপ করে গেলামআসলেই তাে, অশরীরী এক বালিকার উপস্থিতিই তাে যথেষ্টসুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি নিজেও হয়তাে দেখতে পারবেনআমি চমকে উঠলামভদ্রলােক সহজ স্বরে বললেন, আমি ছাড়াও অনেকে দেখেছে। 

সুধাকান্তবাবু ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গেসঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলামউঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হােহাে করে কে যেন হেসে উঠলসুধাকান্তবাবু পাশে না থাকলে অজ্ঞানই হয়ে যেতামআমি তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠলাম, কে, কে

সুধাকান্তবাবু বললেন, ওটা কিছু নাআমি ভয়জড়ানাে গলায় বললাম, কিছু না মানে

ওটা খাটাশমানুষের মতাে শব্দ করে হাসেবলেন কী! খাটাশের নাম তাে এই প্রথম শুনলামতাে ভূতের বাবা বলে মনে 

হচ্ছে! এখনাে আমার গা কাঁপছে। 

জল খানজল খেলে ভয়টা কমবে। 

বৃহন্নলা-পর্ব-(৩)

সুধাকান্তবাবু কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেনখাটাশ নামক জন্তুটি আরেক বার রক্ত হিমকা হাসি হাসলসুধাকান্তবাবু যদি কিছু না বলতেন তাহলে ভূতের হাসি শুনেছি, এই ধারণা সারা জীবন আমার মনের মধ্যে থাকত। 

লােকটার প্রতি এই প্রথম আমার খানিকটা আস্থা হলআজগুবি গল্প বলে ভয় দেখান এই লােকের ইচ্ছা নয় বলেই মনে হল। এরকম ইচ্ছা থাকলে, এই ভয়ংকর হাসির কারণ সম্পর্কে সে চুপ করে থাকত। 

 

Read more

বৃহন্নলা-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *