স্যার সিগনেচার বন্ধ রেখে টেবিলে রাখা সােনালি চশমা চোখে দিয়ে মােবারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মােবারক ?
মােবারক বলল, জ্বি।
বসুন। মােক বসল।
আপনি এক সময় শিক্ষকতা করতেন। জি।
আমিও এক সময় শিক্ষকতা করতাম। একটা প্রাইভেট কলেজে তিন মাস পড়িয়েছি। তিন মাসে এক মাসের বেতন পেয়েছি। যাই হােক, আপনি কিডনী বিক্রি করতে চান কেন।
মােবারক বলল, টাকার জন্যে চাই স্যার। শখ করেতাে আর কেউ কিডনী বিক্রি করে না।
আপনার টাকা দরকার। জি স্যার। কত টাকা চাচ্ছেন?
আমার দরকার দুই লাখ টাকা।
আরাে কিছু মানুষ এসেছে যারা আপনার মত কিডনী বিক্রি করতে চায়। তবে তারা চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার। আপনি এত চাচ্ছেন কেন? আপনার কিডনীর কোয়ালিটি কি ভাল?
খুব ভাল হবারতাে কথা না। আপনারটা হল মেড ইন বাংলাদেশ। মেড ইন বাংলাদেশের জিনিস সাধারণত ভাল হয় না।
মােবারক চুপ করে রইল। দ্রলােক রসিকতা করছেন। রসিকতায় মজা পেয়ে তার হাসা উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। বােকা সেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সেটাই মনে হয় ভাল হবে।
দুই লাখ টাকা দিয়ে কী করবেন? একটা ব্যবসা করার ইচ্ছা। কী ব্যবসা। এখনাে চিন্তা করি নাই। আগেভাগে চিন্তা করে তাে কোনাে লাভ নাই। বিবাহ করেছেন।
জ্বি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনাকে জগলু একজন ডাক্তারের ঠিকানা দেবে। তার সঙ্গে যােগাযোেগ করবেন। ডাক্তার বােধহয় কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করবেন। তারপর তিনি যদি ok বলেন,
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
তখন কিডনীর দরদাম নিয়ে আমরা বসব।
জি আদা। থাকেন কোথায় ?
একটা মেসে থাকি । দেশের বাড়ি কোথায়? নেত্রকোনা।
আপনাদের নেত্রকোনায় বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। মিষ্টিটার। নাম বালিশ। বালিশ মিষ্টি কখনাে খেয়েছেন?
জ্বি স্যার। খেতে কেমন? চমচমের মত।
এখন আপনি যেতে পারেন। মােবারক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব স্যার? বলুন। আপনাকে দেখে মােটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
আমিতাে অসুস্থ না। শরীরের একটা যন্ত্র কাজ করছে না। এটাকে অসুখ বলা ঠিক না।
স্যার যাই। স্লমালিকুম। ওয়ালাইকুম সালাম।
স্যার আবার সিগনেচারে মন দিলেন। মানুষটার বয়স পঞ্চাশ। দেখে অনেক কম লাগছে। কিডনী নষ্ট হয়ে গেলে চেহারা সুন্দর হয় কি-না কে জানে। দ্রলােককে সুন্দর লাগছে। চোখে মুখে গােলাপী আভা। দীর্ঘদিন ভাল ভাল খাবার খেলেও হয়ত চোখে মুখে গােলাপী আভা আসে।
মােবারক একটা সিগারেট ধরালাে। একটা পকেটে রেখে দিল। রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে একটা ধরাতে হবে। ভাল সিগারেটের সত্যিকার যদি তখন আঁওয়া যাবে।
ম্যানেজার সাহেব আসতে দেরি করছেন। টেবিলে বেশ কিছু ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনাে একটা হাতে নিলে ধর্ষণের কোনাে সচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সময় কাটানাের জন্যে খুন এবং ধর্ষণ বিবরণের তুলনা হয় না। মােবারকের ম্যাগাজিন পড়তে ইচ্ছা করছে না। সে চাদরটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে ভাজ করে সামনে রাখল। ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে যাবার সময় খুব সহজ ভঙ্গিতে চাদরটা নিয়ে উঠে যাওয়া যাবে।
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
যেতে হবে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তখন কেউ যদি কিছু বলে, তাহলে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হবে— কী সর্বনাশ, কার চাদর আমি নিয়ে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ যখন চাদরটার খোঁজ করেনি তখন আশা করা যায় যে শেষ পাঁচ মিনিটও কেউ খোঁজ করবে না। বাকিটা কপাল।
ম্যানেজার সাহেব ঢুকলেন। হাতে একটা কাগজ। কাগজে ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা লেখা। ম্যানেজার সাহেব পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে সব জানানাে আছে। আপনি উনার কাছে কার্ডটা শুধু দেবেন। নিন কার্ডটা রাখুন। হারাবেন না।
মােবারক বলল, জি আচ্ছ।
ম্যানেজার সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনাকে একটা ভাল পরামর্শ দেই। কিডনীর দাম নিয়ে দরাদরিতে যাবেন না। এটা স্যারের হাতে ছেড়ে দিলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বুঝতে পারছেন?
জ্বি পারছি।
স্যার যদি আপনার উপর খুশি হন, তাহলে বাকি জীবনের জন্যে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট কোথায় হবে জানেন?
জ্বি-না। সুইজারল্যান্ড। বিনা খরচায় সুইজারল্যান্ড দেখে চলে আসবেন। পাসপাের্ট কি করিয়ে ফেলব? আগে সব ঠিকঠাক হােক।
মােবারক বলল, আমার উপর একটু দোয়া রাখবেন ভাই সাহেব। যেন বাণিজ্যটা হয়।
ম্যানেজার সরু চোখে তাকান। মােবারকের বাণিজ্য কথাটা তার মনে হয়
আবার পুরনাে জায়গায় ফিরে আসা। ম্যানেজার সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। পাশের চেয়ারে চাদর এবং সিগারেট আগের মতই আছে। আশ্চর্য! মালিক কোথায় ? বারােটা সিগারেট থেকে আরেকটা কমলে তেমন ক্ষতি কী
পছন্দ হল না।
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
মােবারক বলল, স্যার উঠি ? বলতে বলতেই চাদর হাতে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাড়াল। সিগারেটের প্যাকেট আগেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। চাদর নিয়ে লােকটা চলে যাচ্ছে এটা মনে হয় তার চোখে পড়ছে না। | হাঁটতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। গল্পগুজবে ম্যানেজার সাহেবকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। মােবারক বলল, আয়না কোথায় ম্যানেজার সাহেব।
জগলু ভুরু কুঁচকে বলল, আয়না কোথায় মানে কি? আয়না নামের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আয়না নামে কেউ এ বাড়িতে নেই।
অবশ্যই আছে। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কেজি ওয়ানে পড়ে। | ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে থাকুক। মােবারক এগুচেচ্ছ। আর একটু গেলেই মুক্তি।
শেষ বাধা গেট। গেটের দারােয়ান কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হয়। মনে হয় জিজ্ঞেস করবে না। দারােয়ান দুই জনেরই বয়স অল্প। অল্প বয়েসী দারােয়ানরা সন্দেহপ্রবণ হয় না। বুড়ােগুলি হয়।
মােবারক কোনাে রকম সমস্যা ছাড়াই গেট পার হল। এখন কেউ গেট খুলে বের হয়ে আসবে এবং তার কাছে ছুটে এসে বলবে, আমার কাশ্মিরী শাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্তিক মাসের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও শাল গায়ে দেয়ার মত না। তাতে কী ? মােবারক শাল গায়ে দিয়ে ফেলল। চৈত্র মাসেও কমপ্লিট স্যুট পরা লােক দেখা গেলে সেও শাল গায়ে দিতে পারে।
জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। বিক্রির আগে কিছুদিন ব্যবহার করা। অনেকটা ধােপর মত। ধােপর দোকানে শাড়ি ধুতে পাঠালে, ধােপার বউ সেই শাড়ি এক দু’বেলা পরে ।
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
ধােপর বাড়িতে শাড়ি গেছে, ধােপার বউ সেই শাড়ি পরেনি এমন কখনাে হয় মাফলার পরার মত শীত পড়েনি, কিন্তু মােবারকের গলায় মাফলার। মাথায় পশমি টুপি। গায়ে উলের চাদর। পশমি টুপি এবং চাদরের কারণে তার চেহারা বদলে গেছে। আয়নায় সে তার নতুন চেহারা দেখেনি, না দেখলেও চেহারা যে বদলেছে এটা নিশ্চিত। চায়ের দোকানের মালিক কুদুস মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেড়া মােবারক না?
মােবারক জবাব না দিয়ে হাই তুলল। পােশাক মানুষের আচার আচরণও বদলে দেয়। টুপি এবং উলের চাদর গায়ে দেয়ার পর থেকে মােবারকের অন্য রকম লাগছে। খাতির জমানাে টাইপ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কুদুস মিয়া তার বন্ধুস্থানীয় মানুষ। সে একটা প্রশ্ন করবে আর মােবারক জবাব দেবে না— এ রকম আগে কখনাে হয়নি।
চা খাইবা মােবারক।
মােবারক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। চায়ের স্টলে ঢুকল। চায়ের স্টলের কোনাে নাম থাকে না, এর নাম আছে- মদিনা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বােধ হয় কুদুসের লেবাসেও ইসলামী ভাব আছে। পায়ের গােড়ালি স্পর্শ করে এ রকম তিনটা পাঞ্জাবী তার আছে। তার মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার পাশ দিয়ে হাঁটলে আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকর্মের সম্পর্ক নাই। নবীজী তাকে স্বপ্নে এ ধরনের পােষাক পরতে বলেছেন বলেই সে পরে। এর বেশি কিছু না। নবীজীর কথা শুনে এ ধরনের পােশাকে পরা শুরু করার পর থেকে নাকি তার ব্যবসার সুবিধা হয়েছে। তবে চা বিক্রি ছাড়াও তার অন্য ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসা নবীজীর পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
মােবারকের মেজাজ সামান্য খারাপ। সে যে চেয়ারে বসে সেখানে একজন কাস্টমার বসে আছে। কাস্টমার যেভাবে চা খাচ্ছে তাতে মনে হয় চা
না।
শেষ করতে ঘণ্টাখানিক সময় লাগাবে। আরে ব্যাটা পিরিচে ঢেলে লম্বা টান। দে। এক টানে ঝামেলা শেষ। তুই বিড়াল নাকি? বিড়ালের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছিস। এক কাপ চা খেতে যদি এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিস অন্য কাজ কখন করবি ?
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মােবারক কাস্টমারের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, ব্রাদার একটু সরে পাশের চেয়ারে বসেন।
কাস্টমার চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, কেন ? এই চেয়ারটায় আমি বসব। খালি চেয়ার তাে আরো আছে সেখানে বসেন।
অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। চায়ের দোকান প্রায় ফাকা । যে-কোনাে জায়গায় বসা যায়। যে আরাম করে বসে চা খাচ্ছে তাকে সরিয়ে তার জায়গাতে বসতে হবে কেন? কাস্টমারের কথায় মােবারকের রাগ হবার কোনােই কারণ নেই। কিন্তু রাগ লাগছে। ইচ্ছা করছে হারামজাদাটার বিশেষ জায়গায় কোৎ করে একটা লাথি মারতে । দুটা বিচির যে কোনাে একটায় লাগলেই খবর আছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মােবারক নিজেকে সামলালাে। এইসব ঝামেলায় একা যাওয়া ঠিক না। একা মানে বােকা। সে উদাস ভাব নিয়ে কাস্টমারের পাশে বসল।
পরিচিত চায়ের দোকান থাকার সুবিধা আছে। মুখে অর্ডার দিতে হয় না। ইশারায় কাজ হয়। অনেক সময় ইশারাও লাগে না। বয় বাবুর্চি, কাস্টমার দেখলেই বুঝে কার কী লাগবে।
চায়ের স্টলের বয় বটু মােবারকের সামনে কাচের গ্লাসে এক গ্লাস মালাই চা রেখে চলে যাচ্ছিল। মােবারক কঠিন গলায় বলল, এই বটু শুনে যা।
বটু থমকে দাঁড়াল। মােবারক বলল, ইটা মাইরা গ্লাস ফেললি। আদব কায়দা জানস না ? চড় দিয়া চাপার দুইটা দাঁত ফেইল্যা দেই। বজ্জাতের বাচ্চা বজ্জাত। বেয়াদবি সবের সাথে করা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে করা যায়।
রূপার পালঙ্ক-পর্ব-৩
বটু চায়ের গ্লাসটা খপ করে নামিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য এতটা রাগ করা যায় না। রাগটা মােবারক করেছে পাশের কাস্টমারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকটা ঝিকে মেরে বউকে শিখানাের মত। শিক্ষাটা মনে হয় কাজে লেগেছে। পাশে বসে থাকা কাস্টমার তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাটার চোখে ভয়। চুক-চুক চা খাওয়া বন্ধ করেছে।
মােবারক বটুকে বলল, এই চা নিয়ে যা, খাব না। মােবারক চাদরের নিচ
থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সাধারণ সিগারেট না। বিদেশী সিগারেট- মারলবােররা। মােবারকের ইচ্ছা করছে সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুর গলায় বলে, ব্রাদার নেন একটা সিগারেট নেন।
কাজটা সে করেই ফেলত’ তার আগেই চায়ের স্টলের মালিক কুদুস মিয়া গলা খাকাড়ি দিল এবং চোখের ইশারায় তাকে ডাকল।
মােবারক বিরক্ত মুখে উঠে গেল। চোখের ইশারায় ডাকাডাকি এটাও তার পছন্দ না। এও এক ধরনের বেয়াদবি। মােবারক সব সহ্য করতে রাজি আছে, বেয়াদবি সহ্য করতে রাজি না।
কুদুস গলা নিচু করে বলল, ঝামেলা কী ? মােবারক বলল, কোনাে ঝামেলা নাই।
Read more