রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৪)

তােমার ডান পাশে যে বসছে তার সাথে কিছু হইছে।

তারে চিনছ ?

মােবারকের চোখ ছােট হয়ে গেল। কুদুসের গলা যেন কেমন কেমন। পাশের লােকটা কি বিশেষ কেউ । কুদুস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে হইল ‘ছােট রফিক’। কথাবার্তা, খুব সাবধান।

রূপার পালঙ্কখুবই সাবধান। তার সাথে বেয়াদবি কিছু কইরা থাকলে মাফ নিয়া নাও। সাপের মাথায় পাড়া দিলে

অসুবিধা নাই। লেজে পাড়া দিলে খবর আছে। | মােবারক মুখ শুকনাে করে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অন্য কোথাও বসতে পারলে ভাল হত। তবে সেটাও ঠিক হত না। ছােট রফিক ঠিকই লক্ষ্য করতাে; মনে মনে ভাবত, লােকটা একটু আগে আমার পাশে বসেছে। এখন

জায়গা বদলেছে।

আল্লাহ পাকের অসীম দয়া যে সে ছােট রফিকের সাথে ঝামেলা করেনি। সে শুধু বলেছে, এই চেয়ারটায় আমি বসব। তবে হােট-রফিককে এই কথা বলাও বিরাট বেয়াদবি।

একজন যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারে তুমি বসবে কেন ? তুমি কোন দেশের লাট বাহাদুর ? তুমি হলে মােবারক। তােমার দাম তিন পয়সা।

ছােট রফিক চা খাওয়া শেষ করেছে। পাঁচ টাকার একটা নােট চায়ের

কাপের পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে চায়ের দাম এবং বখশিশ একসঙ্গে দিয়েছে। ছােট রফিক মােবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গা ছেড়ে দিলাম বসেন। আরাম করে চা খান।

মােবারক মুখ হাসিহাসি করার একটা চেষ্টা করল। ছােট রফিক সেই হাসিমুখ দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে । কৃচ্ছস মিয়া ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল। ছােট রফিক সেদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে সালাম নিল। কোনাে দিকে না তাকিয়েও চারদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারা বিরাট ব্যাপার। মােবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বটু চা দে। মালাই চা না, নরম্যাল চা।

বটু গলা নামিয়ে বলল, উনারে চিনেছেন ? ছােট রফিক। একবার আমারে পঞ্চাশ টাকার চকচকা নােট বখশিশ দিছিল।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারক উদাস গলায় বলল, ভাল। তার এখন বেশ ভালও লাগছে । নিজের চেয়ারে আরাম করে পা তুলে বসে এখন মারলবােরাে সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া যায়। আজ অল্পের উপর দিয়ে ফাড়া কেটেছে। মােবারকের সামান্য আফসােসও হচ্ছে। ছােট রফিককে চেয়ার ছাড়তে না বলে সে যদি দ্রভাবে পাশে বসত এবং সিগারেট সাধত তাহলে কত ভাল হত। সে রকম খাতির হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাইজান আপনাকে ছােট রফিক বলে কেন ? আপনি যদি ছােট রফিক হন— বড় রফিকটা কে ? হা হা হা। ভাইজান রসিকতা করলাম। কিছু মনে করবেন না।

ছােটখাট মানুষ হলে ছােট রফিক ডাকা যায়। কিন্তু মানুষটা মােটেই ছােটখাট না— লম্বা তবে রােগা। গাল বসে গেছে। চেহারা ভাল। দেখে মনে হয় কোনাে ব্যাংকে ট্যাংকে কাজ করে। মানুষটার গলার স্বরে রাগ আছে, কিন্তু চেহারায় কোনাে রাগ নেই । বয়স কত হবে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারকের বয়স আটত্রিশ। কিন্তু তাকে দেখা যায় পঁয়তাল্লিশের মত। সব চুল পেকে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। নিয়মিত কলপ করাও সমস্যা। একেকবার কলপে ত্রিশ টাকা লাগে । পশমি টুপিটা পাওয়ায় বিরাট কাজ হয়েছে। মাথা ঢেকে ঘােরাঘুরি করলে কে বুঝবে টুপির নিচের চুল কাঁচা

পাকা? টুপিটাও সুন্দর! এই টুপি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সরাসরি পাওয়া উপহার। আল্লাহপাক তার নাদান বান্দাদের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য উপহার পাঠান। বান্দা ভাল না মন্দ সেদিকে তাকান না। এত কিছু দেখলে তার চলে না।

দোতলা বাসের দোতলায় বসে মােবারক আসছিল মীরপুর থেকে। তার আগারগায়ে নেমে যাবার কথা। বসে থাকতে ভাল লাগছিল বলে নামল না। যতদূর যাওয়া যায় যাওয়া থাক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের একটা ইশারা অবশ্যই আছে। বাস যখন প্রেসক্লাবের কাছাকাছি তখন তার পাশের একজন যাত্রী তাড়াহুড়া করে নেমে গেল। মােবারক দেখে সিটের উপর একটা নীল আর শাদা রঙের মিশেল দেয়া পশমি টুপি। মােবারক চট করে জায়গা বদল করে পাশের সিটে চলে এল। টুপির উপর খানিকক্ষণ বসে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টুপির মালিক ফিরে আসতে পারে। যদি ফিরে আসে তাহলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলতে হবে। আরে এইত আপনার টুপি! জিনিস পত্র সাবধানে রাখবেন না।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

টুপি নিতে কেউ এল না। মােবারক টুপি হাতে গুলিস্তানে নেমে পড়ল। নেমে পরার আগে ছােটখাট একটা বাণিজ্যও হয়ে গেল। সে বাসের কন্ডাকটারকে বলল, কই ভাই আমার টাকা দিলেন না।

বাসের কন্ডাকটার চোখ গরম করে বলল, কীয়ের টাকা? কন কী?

মােবারক বলল, দশ টাকার একটা নােট দিলাম। আপনি বললেন এখন ভাংতি নাই পরে দিবেন।

কভাকটার চোখ আগের চেয়েও গরম করে বলল, কী কন? দিল্লেগী করেন। ধাক্কা দিয়া চাক্কার নিচে ফেলাইয়া দিমু…

মােবারক শান্ত গলায় অন্য পেসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসাব দেখলেন কী বলে? ধাক্কা দিয়ে চাকার নিচে ফেলে দেবে। তখনি আমি টাকা দিতে চাই নাই। আমি বলেছি ভাংতি নিয়ে আস তারপরে নােটটা নাও। তখন

সেটা করবে না।

এক যাত্রী ক্ষিপ্ত গলায় বলল, শুওরের বাচ্চার গাল বরাবর একটা চটকনা দেন। হারামজাদার কত বড় সাহস।

চটকনা দিতে হল না। তার আগেই কন্ডাকটার একটা দশ টাকার নােট বাড়িয়ে দিল।

মােবারক বলল, এক টাকা ভাড়া কেটে রাখেন। নয় টাকা দেন।

কন্ডাকটার বিরস গলায় বলল, থাউক ভাড়া লাগব না। আফনের ভাড়া মাফ।

মােবারক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, ভাইসাবরা দেখলেন, কীভাবে অপমান করে ? আমার ভাড়া নাকি মাফ।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

অন্য এক কুদ্ধ যাত্রী বলল, হারামজাদারে একটা চড় দেন না। দেখেন কী ? মার না খেলে শিক্ষা হবে না ।

মােবারক জোরেসােরে এক চড় বসিয়ে হেঁটে চলে এল । পিছনে ফিরল না। পিছনে ফিরলে হয়ত দেখা যাবে, কন্ডাকটার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । তবে চড় মারাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। আল্লাহপাকের হিসাবের খাতায় নাম উঠে গেছে। এমন একটা চড় কোনাে না কোনাে সময় মােবারককে খেতে হবে। চড়ে চড়ে কাটাকাটি হবে। সবার হিসাবে ভুল হয়, আল্লাহপাকের হিসাবে ভুল নাই। বাসের কন্ডাকটার যেমন অনেক লােকের সামনে চড় খেয়েছে, সেও অনেক লােকের সামনেই খাবে। হয়ত আজই খেত। ছােট রফিকের হাত থেকে খেত । কপাল গুণে বেঁচে গেছে।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারক চা খাচ্ছে। তার নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। চেয়ারটা এই জন্যে পছন্দ যে এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার লােকজন তাকে এত সহজে দেখবে না। চেয়ারটা মদিনা রেস্টুরেন্টের এক কোণায়। রাস্তার লােক দোকানের দিকে তাকায়, দোকানের কোণার দিকে তাকায় না ।

সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা মােবারকের খারাপ লাগে। বিশ্রী একটা সময়, দিনও না, রাতও না। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার । দিনের এক রকম মজা, রাতের আরেক রকম মজা। এই দুয়ের মাঝামাঝি সময়ের কোনাে মজা নেই। সন্ধ্যা একা কাটানাে যায় না। সন্ধ্যার জন্যে বন্ধু লাগে। মােবারকের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জহিরেরও দেখা নেই, বজলুরও দেখা নেই।

মনে হচ্ছে এরা দু’জন যুক্তি করে হাওয়া হয়ে গেছে। বজলুর জন্যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে প্রায়ই ডুব মারে। দু তিন দিন পরে হঠাৎ উদয় হয়। এই দু তিন দিন সে কোথায় ছিল, কী করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলে না। প্রাইভেট কোনাে ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সব মানুষেরই কিছু

কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। কিন্তু জহিরের ব্যাপারটা কী ? আবার কোনাে অসুখ বিসুখ হয়নি তাে?

জহিরের হল অসুখ রাশি— এই জ্বর, এই কাশি, এই হাম। মানুষের হাম হয় একবার ছােটবেলায়। গা ভর্তি হাম বের হল। হাম ডেবে গেল, মামলা ডিসমিস। সেই হাম জহিরের হয়েছে তিনবার। জন্ডিস হল চারবার। শেষবারে। এমন অবস্থা যে, কলাবাগানের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে তওবা পড়ানাে হল। তওবা পড়ানাের পর মিলাদ হল । বজলু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জহিরকে বলল- তুই এখন শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে গেলি। বাম কাঁধের ফিরিশতা এতদিন তার খাতায় যা লিখেছে সব মুছে গেছে।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

আগের সব পাপ কাটাকাটি হয়ে গেছে। যে অসুখ বাধিয়েছিস এর মধ্যে নতুন পাপ আর কিছু করতে পারবি না। যদি মারা যাস স্ট্রেইট বেহেশত নসিব হবে। হপরী তােকে নিয়ে টানাটানি রু করে দেবে।

আল্লাহপাকের বােধহয় ইচ্ছা না জহির বেহেশতে দাখিল হয়। সে তওবা। পড়ানাের দিন তিনেকের মধ্যে উঠে বসে চি চি করে বলল তার সরষে শাক দিয়ে ক্যান ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। তােকজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। জহিরের গুলি গেছে বগলের তলা দিয়ে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন- আপনার লিভার মারাত্মক ড্যামেজড় হয়েছে।

আপনি যে বেঁচে আছেন এইটাই মিরাকল। বাকি জীবন আপনাকে খুব রেগুলেটেড লাইফ মেইনটেইন করতে হবে। মাংস পারতপক্ষে খাবেন না। মাছ ভাত খাবেন। মদ্যপান করবেন না। ঈদে চান্দেও না। ড্রপার দিয়ে এক ফোটাও না। বুঝতে পারছেন ?কারাে কারাে জন্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনার জন্যে মদের গন্ধ শোকাও নিষিদ্ধ।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

বজলু এবং মােবারক দু’জনই হঁ্যা সূচক মাথা নাড়ল। এবং এক সঙ্গে বলল, জি আচ্ছা।

ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা দুজন মাথা নাড়ছেন কেন? আপনারা কে ?

স্যার আমরা জহিরের ফ্রেন্ড।

আপনারা সামনে থেকে যান। আমি আপনাদের বন্ধুকে কিছু কঠিন কথা বলব। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চলে যান।

ডাক্তার সাহেব অনেক কঠিন কথা বললেন। জহির ঝিমঝিম চোখে হাই তুলতে তুলতে কঠিন কথা শুনল। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে কখনােই বিচলিত হয় না।

(চলবে)

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৩)

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *