সাজঘর (পর্ব-১৮): হুমায়ূন আহমেদ

গ্রুপ নাটকের কত সমস্যা, তার পরেও যে গ্রুপ নাটক টিকে আছেকেন আছে? এই কারণেই আছে। 

সাজঘরবিদায় নেবার সময় লীনা আপা তার দিকে তাকিয়ে এমন মিষ্টি করে হাসল, তবু তার অসম্ভব মন খারাপ হলকারণটা খুব অদূতবৃষ্টি পড়ছিল বাইরেতারা সবাই বারান্দায়জলিল ভাই বললেন, সবাইকে আমি গাড়িতে পৌছে দেবদরকার হলে দুট্রিপ দেবনাে প্রবলেমসবাই তাতে খুশিআর আশ্চর্য, আসিফ ভাই বলল, আমাদের পৌছে দিতে হবে নাবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কিশায় করে যাওয়ার অন্যরকম আনন্দ আছেকাজেই শুভ রাত্রি। 

তারা সত্যিসত্যি রাস্তায় নামলআসিফ ভাই লীনা আপার হাত ধরে হাঁটছেনবৃষ্টির মধ্যে দুজন নেমে যাচ্ছে। 

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটছেকি অপূর্ব দৃশ্য! প্রথম কয়েক মুহূর্ত পুষ্পের মন আনন্দে পূর্ণ হলতার পরপরই চোখে পানি এসে পড়ার মতাে কষ্ট হতে লাগল। 

কেন তার কষ্ট হচ্ছে এটা সে জানেকিন্তু তার বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে নাতার 

কষ্টের কারণটা সে জানে, অথচ কাউকে সে বলতে পারবে নাএও একটা বিরাট কষ্টভালাে এক জন বন্ধু যদি তার থাকত, তাহলে কি সে তাকে এটা বলতে পারত? না পারত নাকোনােদিন কাউকে এটা বলা যাবে না। চিরকাল গােপন রাখার মতো কিছু কিছু ঘটনা সব মানুষের জীবনেই হয়ত ঘটে

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

বাইরের কেউ কোনােদিন তা জানতে পারে নাবড়চাচার মেয়ে মিতুরও একটা গােপন কথা আছে, যা সে কাউকে বলতে পারবে নাশুধু পুষ্পকে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, একটা গােপন কথা তােকে বলবকাউকে না বলতে পারলে আমি মরে যাব‘ পুষ্প বলল, কী?‘ 

মিতু বলল, কিছু না, এম্নি ঠাট্টা করছিবলতে বলতে আবার কেঁদে অস্থির হলমিতুর গােপন কথা পুষ্প জানে নামিতু বলে নিকাউকে হয়ত সে আর বলবে নাগােপন কথা গােপনই থেকে যাবে। 

পুষ্প বাড়িতে ঢুকে শান্ত ভঙ্গিতে হাতমুখ ধুয়ে মাকে গিয়ে বলল, ভাত দাও মা। মমতা বললেন, তাের কী হয়েছে রে? এমন লাগছে কেন

ভীষণ মাথা ধরেছেখেয়ে শুয়ে পড়বতাের চাচীর ওখানে গিয়ে খেয়ে আয়ভাল ছাড়া ঘরে আর কিছু খাবার নেইডাল দিয়েই খাবঘরে এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। 

মমতা উঠে গিয়ে রান্নাঘরেই মেয়েকে ভাত বেড়ে দিলেনপূষ্প বলল, তুমি খাবে না মামমতা বললেন, বুকে অম্বলের ব্যথা উঠেছে, এক কাপ দুধ খেয়ে শুয়ে পড়বতােকে একটা ডিম ভেঙ্গে দেই‘ 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

দাও‘ মমতা ডিম ভাজতে ভাজতে বললেন, আজ এক কাণ্ড হয়েছে সন্ধ্যাবেলা একটা গাড়ি করে দুতিন জন মহিলা এসে উপস্থিতকাউকে চিনি নাবললাম কাকে চান? | মােটামতাে একজন মহিলা বললেন, আমরা আপনার প্রতিবেশী, বেড়াতে এসেছিআমার তখনি সন্দেহ হল

প্রতিবেশী হলে গাড়ি করে আসবে কেন? কেমন অস্বস্তিঅস্বস্তি ভাবহেন তেন নানান কথার পর ফস করে বলল, আপনার বন্ধু মেয়েটার কি বিয়ে দেবেন? চিন্তা কর অবস্থাচিনি না জানি না এসেই বলে কি নাবড় মেয়ের বিয়ে দেবেনপুষ্প বলল, তুমি কী বললে?‘ 

আমি আবার কী বলব? আমি বললাম, জ্বি নামেয়ের বিয়ের কথা এখনাে ভাবছি নাওমা, তার পরেও যায় নাবসেই আছে। 

পুষ্প বলল, চুপ কর তাে মাশুনতে ভালাে লাগছে না। 

আহা, আসল মজাটা তাে শুনলি নাখুব ফর্সা করে এক জন মহিলা আছেন, উনি বললেনবিয়ের সম্পর্ক এলে মুখের উপর না বলতে নেই আপাপ্রপােজাল শুনুন, তারপর বলুন না৷ 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, এম. পাশ করার আগে মেয়ের বাবা মেয়ের বিয়ে দেবে না। 

ভদ্রমহিলা বললেন, এম, পাশ তাে বিয়ের পরেও করতে পারেকী যে যন্ত্রণাকিছুতেই যাবে না‘ 

তারপর বিয়ে করলে কী ভাবে

শেষ পর্যন্ত বললাম, আপা, আমাদের এক জায়গায় যাবার কথা আছে। তারপর উঠল। 

পুষ্প বলল, তােমার মজার কথা শেষ হয়েছে, না আরাে বাকি আছে?‘ 

আসলটাই তাে বলা হয় নিওরা চলে গেলে দেখি টেবিলের উপর চশমা পরা একটা ছেলের ছবিইচ্ছা করে ফেলে গেছেমিতুর কাছে বিটা আছেদেখতে চাইলে ওকে বল‘ 

আমি কেন দেখতে চাইব

আহা রেগে যাচ্ছিস কেন? দেখতে না চাইলে দেখবি নানাটক থিয়েটার করতে পারিস, একটা ছেলের ছবি দেখলে তাের মান যাবে নাকি? 

নাটক থিয়েটার আমি আর করব নাকী বললি

নাটক আমি আর করব নাহঠাৎ কী হল

আমার ভালাে লাগছে না। 

পুষ্প উঠে চলে গেলসে রাতে মিতুর সঙ্গে শােয়আজ নিশ্চয়ই দেশের বাড়ি থেকে কেউ এসেছেচিড়িয়াখানা দেখবে কিংবা চিকিৎসা করাবেকারণ মিতুর বিছানায় অপরিচিত এক জন মহিলা ঘুমুচ্ছেনমিতুও তার স্বভাব মতাে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে পুষ্প তার নিজের শােবার জায়গা খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হল নাভেতরের দিকের বারান্দায় চলে গেল

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

রেলিং দেয়া বারান্দার এক কোণে একটা ইজিচেয়ারপুর বাবা এই চেয়ারে বসে রােজ সকালে খবরের কাগজ পড়েনরাতে চেয়ারটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ নেয়া হয় নি। পুষ্প চেয়ারে এসে বসল

বৃষ্টি হচ্ছে নাঝিঝি ডাকছেঝিঝি ডাকা মানে বাকি রাতটায় আর বৃষ্টি হবে নাআকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠবেচাঁদ উঠলে পুষ্পদেরবাড়ির ভেতরটা খুব সুন্দর দেখা যায়ভেতরের উঠোনে দুটো প্রকাও কামিনী গাছ আছেসেই গাছে চাঁদের আলাে পড়েবড়ই রহস্যময় লাগে। 

পুষ্প চুপচাপ বসে আছেবসে থাকতে থাকতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়লঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখলএই স্বপ্নটি বড় মধুর ছিল, তবু সে ঘুমের মধ্যেই খুব কাঁদল। 

খুব ভােরে লীনার ঘুম ভাঙল। এই ভােরগুলােকেই বােধ হয় কাকভাের বলেতারস্বরে কাক ডাকছেঘরের ভেতর আঁধার আলাে। সেই আলােঅন্ধকারে মিশে পৃথিবীটাকে অনারকম করে রেখেছেশহরের ভােরে পাখির ডাক শােনা যায় না। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

কর্কশ কাক ডাকেকাককে তাে আর কেউ পাখি ভাবে না। 

আসিফ পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছেএকটা হাত মুখের উপর ফেলে রাখায় মুখ দেখা যাচ্ছে নালীনার একবার ইচ্ছা করল, আসিফকে ডেকে তােলে। এত আরাম করে সে ঘুমুচ্ছে যে ডাকতে ইচ্ছা করল না। লীনা দরজা খুলে বাইরে এলরান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছেবেনু তার বাচ্চার জন্যে দুধ গরম করছে। লীনা রান্নাঘরে ঢুকল। চায়ের পানি চড়াবেঅনেকদিন বেডটি খাওয়া হয় না। 

বেনু মুখ তুলে লীনাকে দেখলকিছু বলল নাবেনুর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীরলীনা বলল, বাচ্চা জেগে গেছে

‘চা খাবে বেনু? আমি চা করছিচা খাব না। আজ আপনি চলে যাবেন, তাই না

মন খারাপ লাগে

একটু লাগেতােমারও কি মন খারাপ? কেমন যেন লাগছেঝগড়াটগড়া হয়েছে? 

বেনু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনটা খুব খারাপখুকির বাবা কাল রাতে আমাকে চড় দিয়েছে। নিজের বাবামা কোনােদিন আমার গায়ে হাত তুলে নাই

 আর কি না, ..। 

বেনুর বাচ্চা কাঁদছেসে দুধ নিয়ে চলে গেললীনাকে সুন্দর ভােরবেলায় অসুন্দর একটি ছবির মুখােমুখি হতে হলবেচারা বেনুআজ সারাদিন খুব মন খারাপ করে থাকবে। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

আগামীকাল বা পরশুও এরকম যাবেতারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। স্বামীর সঙ্গে হাসবে, গল্প করবেস্বামীর প্রয়ােজনে লাজুক ভঙ্গিতে রাউজের হুক খুলবেতারপর আবার একদিন রকম একটা কাণ্ড ঘটবেস্বামী চড় বসাবে কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে মেঝেতে। 

লীনা দুকাপ চা বানিয়ে শােবার ঘরে ঢুকলআসিফ একটা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েছেবেচারার বােধ হয় শীত করছিলডেকে তুলে চা খেতে বলবে? না থাক, বেচারা ঘুমুযদিও ডেকে তুললেই ভালাে হতআজ লীনা চলে যাবেযাবার দিনটায় যত বেশি পারা যায় গল্প করা উচিত। 

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *