সাজঘর (পর্ব-১৮): হুমায়ূন আহমেদ

 লােকজন বাসায় এসে ভিজিট দিয়ে ব্যবস্থাপত্র নেয়সাজঘরপুষ্পদের বাসায় অনেকগুলাে ভাইবােননিজের এবং চাচাতাে বােনদের সংখ্যা সাতভাই জনএরা রাতে কে কোথায় ঘুমায় কোনাে ঠিক নেইপ্রায়ই দেখা যায় অনেক রাতে এক জন পড়াশােনা শেষ করে উঠেছেকোথায় ঘুমাবে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। 

রান্না দুবাড়িতে আলাদাভাবেই হয়, তবে কে কোন বাড়িতে খাবে তারও কোনাে ঠিক নেইপুস্পের বড়চাচা খলিলুদ্দিন বেশিরভাগ সময়ই পুষ্পদের সঙ্গে খাননিজের স্ত্রীর রান্না তিনি খেতে পারেন নাখেতে বসে বেশিরভাগ সময়ই খুব অপমানসূচক কথা বলেনআজ তাই বলছেনআজ রান্না হয়েছে তেলাপিয়া মাছতিনি মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিলেন এবং থমথমে গলায় বললেন, জিনিসটা কি

তাঁর স্ত্রী হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তেলাপিয়া মাছতেলাপিয়া মাছ রাঁধতে তােমাকে কে বলল? সবাই খায়সবাই খায়? কোন শালা তেলাপিয়া মাছ খায়? বল কোন শালা খায়?‘ 

তিনি মাছের বাটি উল্টে ফেলে গট গট করে উঠে পাশে ছােট ভাইয়ের বাসায়খেতে গেলেন। সেখানেও তেলাপিয়া মাছ রান্না হয়েছেতবে সেখানে তিনি কোনাে উচ্চবাচ্য করলেন না

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

পাম্প এই দুই পরিবারেরই বড় মেয়েপরিবারে সবচে বড় মেয়েকে কখনাে ঠিক বড় মনে হয় নামনে হয় সে ছােটই রয়ে গেছেপুষ্প সম্পর্কে এই ধারণা আরাে কিছুদিন থাকতাে, তবে এখন আর নেইপুষ্প রিহার্সেলে রােজ শাড়ি পরে যাচ্ছেশাড়ি পরলেই মেয়েটাকে তরুণীর মতাে দেখায়। 

পুষ্পের বাবা এজাজুদ্দিন ভেবেছিলেন দু’এক দিনের ব্যাপারএখন মনে হচ্ছে দুএকদিনের ব্যাপার নাবােজই যাচ্ছেওরা অবশ্যি গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছেএবং দোতলার ভাড়াটে মেয়েটাও যাচ্ছেতবু একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। 

স্বভাবচরিত্রে কোনাে দাগ পড়ে গেলে মুশকিল| এজাজুদ্দিন স্ত্রীকে কদিন ধরেই এই কথাটা বােঝাতে চেষ্টা করছেন। গম্ভীর গলায় বলছেন, একটা দাগ পড়ে গেলে খুব মুশকিলদাগ তাে শরীরের কোনাে অসুখ না যে থুজা টু হানড্রেড দেব আর রােগ আরাম হবে।

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

এজাজুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী মমতা তাঁর স্বামীর কোনাে মতামতকেই তেমন পাত্তা দেন নামেয়ের নাটক করার ব্যাপারে তাঁর সায় আছেরক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও আছেকে আছে এই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার নয়একদিন তিনি মেয়ের অভিনয়ও দেখে এলেনমেয়েকে শুধু বললেন, ‘ছেলেটার গায়ের উপর এমন লেপ্টে পড়ে যাওয়ার দরকার কি? একটু দূরেদূরে থাক” 

পূষ্প বলেছে, আচ্ছা। 

মমতা বলেছেন, যখন ছেলেটা হাত ধরবে, তখন হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবিযে বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না, খালি বই লেখে তার সঙ্গে এত কি মাখামাখি

বুঝলি, হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবি। 

পুষ্প হেসে বলেছে, আচ্ছাভাের স্বামী হয়েছে যে, ছেলেটা কে

তার নাম আসিফবিয়ে করেছে

বউকে তাে দেখলাম নাউনি এখন আসেন নাশরীর ভালাে না‘ 

দেখতে কেমন? খুব সুন্দরীঅবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

ছেলেটির স্ত্রী খুবই সুন্দরী, এটা শােনার পর মমতার দুশ্চিন্তা পুরােপুরি চলে যায়থিয়েটারের লােকগুলােকে তাঁর ভালােই লাগেবিশেষ করে মেয়েগুলােকেএর মধ্যে এক জনযে মায়ের ভূমিকা করে তাঁকে তাঁর খুবই মনে ধরলদেখেই মনে হয় শক্ত ধরনের মহিলা। এরকম শক্ত ধরনের মহিলা থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়মমতা পুরােপুরি নিশ্চিন্ত হলেনমহিলাকে বললেন, আমার মেয়েটাকে একটু চোখে চোখে রাখবেনসেই মহিলা সঙ্গেসঙ্গে বললেন, সে কি, আপনার মেয়ে তাে আমারও মেয়েমমতা বড় শান্তি পেলেন। 

পুষ্প যে পরিবার থেকে এসেছে, সেই পরিবারের সদস্যরা কোনাে কিছু নিয়েই তেমন মাথা ঘামায় নাএতগুলাে ছেলেমেয়ে যেখানে বড় হয় সেখানে কারাে উপর তেমনভাবে নজর রাখা যায় নাকেউ অন্যায় কিছু করলেও তা মনে থাকে নাএজাজুদ্দিন সাহেব একদিন দেখলেন বাড়ির এক জন ছেলে রাস্তায় পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছেতিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলেন! অপরাধী কে তা তিনি ঠিক ধরতে পারলেন নাকে ছিল? বাবলু না মহিন? অনেকক্ষণ হৈচৈ করার পর তাঁর রাগ কমল

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

পুষ্প হৈচৈ কান্নাকাটি করে থিয়েটারে যােগ দেবার ব্যবস্থা করেছেপ্রথমে ব্যাপারটায় সবার খুব আপত্তি থাকলেও, এখন মনে হচ্ছে কারাের মনেই নেইপুষ্পর চাচা একদিন রাতে গাড়ি থেকে নামতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কোথেকে আসছিস?” 

পুষ্প বলল, থিয়েটার থেকেথিয়েটার! কিসের থিয়েটার? ভুলে গেছেন চাচা? আমি একটা নাটক করছি না? নাটক, কবে? সামনের মাসে। 

আচ্ছাআচ্ছারাতবিরাতে ফিরতে হয় নাকি? এটা তাে ভালাে কথা নাদশটা বাজেদশটা পর্যন্ত নাটক করলে পড়বি কখন

এই নাটকটা করে আর করব না চাচা। 

গুডভেরি গুড়রিহার্সেল থেকে পুষ্প সব সময় হাসিখুশি হয়ে ফেরেআজ তার মুখটা কালাে। 

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

যেন বিরাট কোনাে দুর্ঘটনা ঘটেছেঅথচ রিহার্সেলে তার সময়টা খুব ভালাে কেটেছেআজমল নামের এক জন ভারিক্তি ধরনের লােক তাকে অনেক মজারমজার কথা বলেছেসেই সব কথার মধ্যে একটা হচ্ছে, এই মেয়ে, ফস করে কাউকে বিয়ে করে বসবে নাতাহলে নাটক মাথায় উঠবেতােমার অভিনয় খুব ভালাে হচ্ছেকিছুদিন পর দেখবে পথে বের হতে পারবে না। অটোগ্রাফঅটোগ্রাফ বলে লােকজন মাথা খারাপ করে দেবেঅটোগ্রাফ কী করে দিতে হয় সেটাও শিখে নাওখুব সহজ একটা সিগনেচার তৈরি কর, যাতে খুব দ্রুত অটোগ্রাফ দিতে পারকালাে চশমা পরা অভ্যেস 

করতে হবেযাতে লােকজন চট করে চিনতে না পারে। 

লীনা আপাও তার সঙ্গে অনেক কথা বললেন। গায়ে হাত রেখে এত আন্তরিকভাবে কথা বললেন যে, তার চোখ প্রায় ভিজে উঠলরিহার্সেল পুরােপুরি শেষ হবার পর সবাই মিলে যখন চা খাচ্ছে তখন তাকে বললেন, তােমার জন্যে কি কিছুআনতে হবে পু? আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছিতােমার পছন্দের কোনাে জিনিস যদি থাকে তাহলে বলআমি অবশ্যই নিয়ে আসবতবে খুব দামি কিছু আনতে বলবে নাআমার হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

পুশ বলল, আমার জন্যে চন্দন কাঠের একটা পুতুল আনবেনঅবশ্যই আনবআপনি কতদিন থাকবেন

রুতে কথা হয়েছিল দশ দিনেরএখন শুনছি এক মাসের প্রােগ্রাম হচ্ছেতবে আমি এতদিন থাকব নাতােমাদের নাটকের আগে অবশ্যই ফিরে আসব। 

পুল বলল, ‘নাটক আপনাদের খুব প্রিয়

হা প্রিয়া খুবই প্রিয়নাটকের একটা দল মানেপরিবারের বাইরে একটা পরিবার। 

পুষ্প চুপ করে রইল। 

লীনা বলল, কিছুদিন যাক, তখন তুমিও এটা বুঝবেসবাই কিছুদিন পরপর একসঙ্গে হতে না পারলে দেখবে ভালাে লাগছে নাঅস্থিরঅস্থির লাগছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *