লােকজন বাসায় এসে ভিজিট দিয়ে ব্যবস্থাপত্র নেয়।পুষ্পদের বাসায় অনেকগুলাে ভাইবােন। নিজের এবং চাচাতাে বােনদের সংখ্যা সাত। ভাই ছ‘জন। এরা রাতে কে কোথায় ঘুমায় কোনাে ঠিক নেই। প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাতে এক জন পড়াশােনা শেষ করে উঠেছে। কোথায় ঘুমাবে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রান্না দু’বাড়িতে আলাদাভাবেই হয়, তবে কে কোন বাড়িতে খাবে তারও কোনাে ঠিক নেই। পুস্পের বড়চাচা খলিলুদ্দিন বেশিরভাগ সময়ই পুষ্পদের সঙ্গে খান। নিজের স্ত্রীর রান্না তিনি খেতে পারেন না। খেতে বসে বেশিরভাগ সময়ই খুব অপমানসূচক কথা বলেন। আজ তাই বলছেন। আজ রান্না হয়েছে তেলাপিয়া মাছ। তিনি মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিলেন এবং থমথমে গলায় বললেন, জিনিসটা কি?
তাঁর স্ত্রী হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তেলাপিয়া মাছ। ‘তেলাপিয়া মাছ রাঁধতে তােমাকে কে বলল? ‘সবাই খায়। ‘সবাই খায়? কোন শালা তেলাপিয়া মাছ খায়? বল কোন শালা খায়?‘
তিনি মাছের বাটি উল্টে ফেলে গট গট করে উঠে পাশে ছােট ভাইয়ের বাসায়। খেতে গেলেন। সেখানেও তেলাপিয়া মাছ রান্না হয়েছে। তবে সেখানে তিনি কোনাে উচ্চবাচ্য করলেন না।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
পাম্প এই দুই পরিবারেরই বড় মেয়ে। পরিবারে সবচে বড় মেয়েকে কখনাে ঠিক বড় মনে হয় না। মনে হয় সে ছােটই রয়ে গেছে। পুষ্প সম্পর্কে এই ধারণা আরাে কিছুদিন থাকতাে, তবে এখন আর নেই। পুষ্প রিহার্সেলে রােজ শাড়ি পরে যাচ্ছে। শাড়ি পরলেই মেয়েটাকে তরুণীর মতাে দেখায়।
পুষ্পের বাবা এজাজুদ্দিন ভেবেছিলেন দু’এক দিনের ব্যাপার। এখন মনে হচ্ছে দু‘একদিনের ব্যাপার না। বােজই যাচ্ছে। ওরা অবশ্যি গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। এবং দোতলার ভাড়াটে মেয়েটাও যাচ্ছে। তবু একটা অস্বস্তি থেকেই যায়।
স্বভাব–চরিত্রে কোনাে দাগ পড়ে গেলে মুশকিল। | এজাজুদ্দিন স্ত্রীকে কদিন ধরেই এই কথাটা বােঝাতে চেষ্টা করছেন। গম্ভীর গলায় বলছেন, ‘একটা দাগ পড়ে গেলে খুব মুশকিল। দাগ তাে শরীরের কোনাে অসুখ না যে থুজা টু হানড্রেড দেব আর রােগ আরাম হবে।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
এজাজুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী মমতা তাঁর স্বামীর কোনাে মতামতকেই তেমন পাত্তা দেন না। মেয়ের নাটক করার ব্যাপারে তাঁর সায় আছে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও আছে। কে আছে এই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার নয়। একদিন তিনি মেয়ের অভিনয়ও দেখে এলেন। মেয়েকে শুধু বললেন, ‘ছেলেটার গায়ের উপর এমন লেপ্টে পড়ে যাওয়ার দরকার কি? একটু দূরে–দূরে থাক।”
পূষ্প বলেছে, ‘আচ্ছা।
মমতা বলেছেন, ‘যখন ছেলেটা হাত ধরবে, তখন হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবি। যে বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না, খালি বই লেখে তার সঙ্গে এত কি মাখামাখি?
বুঝলি, হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবি।
পুষ্প হেসে বলেছে, ‘আচ্ছা। ‘ভাের স্বামী হয়েছে যে, ঐ ছেলেটা কে?
তার নাম আসিফ। বিয়ে করেছে?
বউকে তাে দেখলাম না। ‘উনি এখন আসেন না। শরীর ভালাে না।‘
দেখতে কেমন? খুব সুন্দরী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
ছেলেটির স্ত্রী খুবই সুন্দরী, এটা শােনার পর মমতার দুশ্চিন্তা পুরােপুরি চলে যায়। থিয়েটারের লােকগুলােকে তাঁর ভালােই লাগে। বিশেষ করে মেয়েগুলােকে। এর মধ্যে এক জন—যে মায়ের ভূমিকা করে তাঁকে তাঁর খুবই মনে ধরল। দেখেই মনে হয় শক্ত ধরনের মহিলা। এরকম শক্ত ধরনের মহিলা থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। মমতা পুরােপুরি নিশ্চিন্ত হলেন। মহিলাকে বললেন, ‘আমার মেয়েটাকে একটু চোখে চোখে রাখবেন। সেই মহিলা সঙ্গে–সঙ্গে বললেন, ‘সে কি, আপনার মেয়ে তাে আমারও মেয়ে। মমতা বড় শান্তি পেলেন।
পুষ্প যে পরিবার থেকে এসেছে, সেই পরিবারের সদস্যরা কোনাে কিছু নিয়েই তেমন মাথা ঘামায় না। এতগুলাে ছেলেমেয়ে যেখানে বড় হয় সেখানে কারাে উপর তেমনভাবে নজর রাখা যায় না। কেউ অন্যায় কিছু করলেও তা মনে থাকে না। এজাজুদ্দিন সাহেব একদিন দেখলেন এ বাড়ির এক জন ছেলে রাস্তায় পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলেন! অপরাধী কে তা তিনি ঠিক ধরতে পারলেন না। কে ছিল? বাবলু না মহিন? অনেকক্ষণ হৈ–চৈ করার পর তাঁর রাগ কমল।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
পুষ্প হৈ–চৈ কান্নাকাটি করে থিয়েটারে যােগ দেবার ব্যবস্থা করেছে। প্রথমে ব্যাপারটায় সবার খুব আপত্তি থাকলেও, এখন মনে হচ্ছে কারাের মনেই নেই। পুষ্পর চাচা একদিন রাতে গাড়ি থেকে নামতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘কোথেকে আসছিস?”
পুষ্প বলল, ‘থিয়েটার থেকে। থিয়েটার! কিসের থিয়েটার? ‘ভুলে গেছেন চাচা? আমি একটা নাটক করছি না? ‘নাটক, কবে? ‘সামনের মাসে।
ও আচ্ছা–আচ্ছা। রাত–বিরাতে ফিরতে হয় নাকি? এটা তাে ভালাে কথা না। দশটা বাজে। দশটা পর্যন্ত নাটক করলে পড়বি কখন?
‘এই নাটকটা করে আর করব না চাচা।
গুড। ভেরি গুড়।। রিহার্সেল থেকে পুষ্প সব সময় হাসিখুশি হয়ে ফেরে। আজ তার মুখটা কালাে।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
যেন বিরাট কোনাে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অথচ রিহার্সেলে তার সময়টা খুব ভালাে কেটেছে। আজমল নামের এক জন ভারিক্তি ধরনের লােক তাকে অনেক মজার–মজার কথা বলেছে। সেই সব কথার মধ্যে একটা হচ্ছে, ‘এই মেয়ে, ফস করে কাউকে বিয়ে করে বসবে না। তাহলে নাটক মাথায় উঠবে। তােমার অভিনয় খুব ভালাে হচ্ছে। কিছুদিন পর দেখবে পথে বের হতে পারবে না। অটোগ্রাফ–অটোগ্রাফ বলে লােকজন মাথা খারাপ করে দেবে। অটোগ্রাফ কী করে দিতে হয় সেটাও শিখে নাও। খুব সহজ একটা সিগনেচার তৈরি কর, যাতে খুব দ্রুত অটোগ্রাফ দিতে পার। কালাে চশমা পরা অভ্যেস
করতে হবে। যাতে লােকজন চট করে চিনতে না পারে।
লীনা আপাও তার সঙ্গে অনেক কথা বললেন। গায়ে হাত রেখে এত আন্তরিকভাবে কথা বললেন যে, তার চোখ প্রায় ভিজে উঠল। রিহার্সেল পুরােপুরি শেষ হবার পর সবাই মিলে যখন চা খাচ্ছে তখন তাকে বললেন, ‘তােমার জন্যে কি কিছু। আনতে হবে পু? আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। তােমার পছন্দের কোনাে জিনিস যদি থাকে তাহলে বল। আমি অবশ্যই নিয়ে আসব। তবে খুব দামি কিছু আনতে বলবে না। আমার হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
পুশ বলল, আমার জন্যে চন্দন কাঠের একটা পুতুল আনবেন। ‘অবশ্যই আনব।‘ ‘আপনি কতদিন থাকবেন?
রুতে কথা হয়েছিল দশ দিনের। এখন শুনছি এক মাসের প্রােগ্রাম হচ্ছে। তবে আমি এতদিন থাকব না। তােমাদের নাটকের আগে অবশ্যই ফিরে আসব।
পুল বলল, ‘নাটক আপনাদের খুব প্রিয়?
‘হা প্রিয়া খুবই প্রিয়। নাটকের একটা দল মানে—পরিবারের বাইরে একটা পরিবার।
পুষ্প চুপ করে রইল।
লীনা বলল, ‘কিছুদিন যাক, তখন তুমিও এটা বুঝবে। সবাই কিছুদিন পরপর একসঙ্গে হতে না পারলে দেখবে ভালাে লাগছে না। অস্থির–অস্থির লাগছে।