সাতকাহন পর্ব-(১৪)-সমরেশ মজুমদার

সাতকাহন

‘মানে ?’ 

তােমার দাড়ি আর কাঁধের ব্যাগ বলে দিচ্ছে শিল্পের জন্যে সংগ্রাম করছ। শুনেছি সংগ্রাম করতে গেলে নাকি এইবকম বেশ দরকার।’ 

‘ঠাট্টা করছ ? 

নাঃ। বল, কি উদ্দেশ্যে আগম? ‘তােমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল । এসে লাভ হল। ‘যেমন ? “তুমি তাে আমাকে আপনি বলতে সবসময়, এসে পড়েছি বলে তুমি শুনলাম। ‘বয়স মানুষকে অনেক জায়গায় উদার করে। ‘তােমার বয়স ! ‘আমার কথা থাক। শুধু দেখার ইচ্ছের জন্যে যদি আসা হয় তাহলে অনায় করেছ। আমি এটা পছন্দ করছি না। মায়া কেমনআছে ? 

‘মায়া ! তুমি জানাে না ? ‘কি জানব? ‘মায়া বিয়ে করেছে। বছরখানেক হয়ে গেল। ‘আচ্ছা ? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল দীপাবলীর। ‘হ্যাঁ। সুদীপকে। সুদীপ তাে আমাদের দল ছেড়ে দিয়েছে। ‘সুদীপকে ? দীপাবলী যেন তল পাচ্ছিল না। ‘ইয়েস ম্যাডাম। জীবন এই রকম। আমি অবশ্য খুব খুশী হয়েছি। তবে মায়া আর সুদীপের টেম্পারামেন্ট আলাদা, এইটেই গােলমাল। অথাৎ মায়া আর শমিতের জীবনে নেই। এতক্ষণ যে স্বাভাবিক ব্যবহার সে করছিল তা যেন অকস্মাৎ হারিয়ে গেল । শমিতের একা হওয়া মানে তার সমস্যা বাড়া—এমন অনুভূতি প্রবল হল। সে কোনমতে জানতে চাইল আমার ঠিকানা পেলে কোথায় ? 

‘তােমার হেড অফিস থেকে। 

কি জন্যে এসেছ এখনও জানলাম না। 

‘এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? যদি আপত্তি থাকে বল বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠেঘাটে রাত কাটিয়ে ফিরে যাই। 

‘সেটা আর বলতে পারছি কোথায় ? 

সাতকাহন পর্ব-(১৪)

বলতে যখন পারছ না তখন এসাে অন্য গল্প করি। তােমার চাকরি কেমন লাগছে ? জায়গাটা কেমন ? রাত্রে খাওয়া দাওয়া চুকে গেলে তিরিকে দিয়ে বাইরের ঘরে বিছানা পাতালাে দীপাবলী শমিতের জন্য। ভেতরের বারান্দায় একটা খাটিয়া পড়েছিল, সেটাকেই নিয়ে আসা হল । তিরি যেমন শােয় তেমনি শােবে দীপাবলীর ঘরে। শুতে যাওয়ার আগে দীপাবলী বলল, ‘কাল ভাের থেকেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তুমি কখন যাবে ? 

‘আমি এখানে কদিন থাকব দীপা।

একটা নাটক লিখছি এদিকের মানুষ নিয়ে।

তাই এদের ভাষা, জীবন জানা দরকার।

একটা দেশলাই দাও তাে ? 

বিরক্ত দীপাবলীর ঘরে ফিরে আসামাত্র দেখল তরতরিয়ে একটা দেশলাই নিয়ে তিরি বাইরের ঘরের দিকে যাচ্ছে। 

ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে। এমনিতেই এ বাড়িতে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ বাজে রাত গড়ালে । গরমের হাত থেকে নিস্তার পেতেও সময় লাগে। ঘরে কেউ থাকলে ওইসব শব্দ উপেক্ষা করতে অসুবিধে হত না দীপাবলীর। কিন্তু এই রাত্রে হয়েছিল। 

মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও পারেনি। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সরিয়ে এনেছিল । দরজা বন্ধ করা মানে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করা। অন্তত খােলা দরজায় একটা উপেক্ষার আবহাওয়া তৈরী করা যায়। কিন্তু পাশের ঘরে কেউ শুয়ে আছে, যার সঙ্গে কাঁচের সম্পর্ক ছাড়া এখন আর কিছু আপাতত অবশিষ্ট নেই, এটা ভাবলেই ঘুম চোখ থকে উধাও হয়ে যায় । চিন্তা হচ্ছিল তিরিকে নিয়েও। দেশলাই দিতে গিয়ে তিরি যে হেসেছিল তা সে এ ঘর থেকেও শুনতে পেয়েছে। মেয়েটাকে কখনও এমন কারণ অকারণে হাসতে শােনেনি। খাবার পরিবেশন করার সময় শমিত অকারণে বলেছিল, ‘বাঃ, তুমি তাে চমৎকার রাঁধে। শােনামাত্র লজ্জায় এমন মুখের ভঙ্গি করেছিল যে দীপাবলী তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল।

সাতকাহন পর্ব-(১৪)

তিরির রান্না আহামরি কিছু নয়। ভাল রান্না শেখার সুযােগও সে পায়নি। বরং এক ধরনের গ্রাম্য গন্ধ থাকে যা মাঝে মাঝে দীপাবলীর কাছেই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু এখানে এটুকু কাজ পরিষ্কার করে করার জন্যে মেয়ে পাওয়া মুশকিল। সতীশবাবুকে বললে অনেকেই আসবে কিন্তু তাদের হাতে খেতে ইচ্ছেই হবে না। দীপাবলীর মনে হয়েছিল শমিত গায়ে পড়ে নেহাত মন রাখতেই প্রশংসা করল। কোন সাধারণ নাটক দেখে শমিত কখনওই এমন কথা বলত না। মানসিকতার বদল কেন স্থান বিশেষে হবে ? দীপাবলীর ধারণা হচ্ছিল, শমিত অনেক পালটে গিয়েছে। 

কিন্তু রাতটা একসময় ঘুম জড়িয়েই কেটে গেল। স্নান করে তৈরী হয়ে সে যখন বাইরের ঘরে এল তখনও শমিত ঘুমাচ্ছে। বাইরে তখন সবে ভাের হচ্ছে। তাপ বাড়ার আগে পৃথিবীটা এই মুহূর্তে নি-রােদ এবং সুন্দর । শমিত ঘুমাচ্ছে একেবারে ছেলেমানুষের মত, দুটো হাটু প্রায় বুকের কাছে নিয়ে এসে। দীপাবলী তিরিকে ডেকে বলল, “দাদাবাবু উঠলে চা দিবি। আমি অফিসে যাচ্ছি।‘ 

শেষ কথাটা সম্ভবত কানে গিয়েছিল, ধড়মড়িয়ে উঠে কল শমিত। জানলা দিয়ে  

বাইরেটা দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কটা বাজে ? 

এমন কিছু নয়। তুমি ঘুমাতে পারাে। কিন্তু আমাকে এখনই অফিসে যেতে হবে‘এই সাতসকালে অফিস ?” ‘গরমের জন্যে নিয়মটা করা হয়েছেদীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল, তােমার কোন দরকার আছে আমার কাছে ?

সাতকাহন পর্ব-(১৪)

 দরকার ? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যায় ?হাসল শমিত। ঠোঁট কামড়াতে গিয়ে সামলে নিল দীপাবলী, তােমার জেনে রাখা ভাল, আমার কোন দরকার নেই তােমার কাছে। আমি কাজে যাচ্ছি‘ দীপাবলী পাশের দরজা দিয়ে অফিস ঘরে চলে এলঘর অন্ধকারসে জানলা খুলে বাইরের ঘরে চলে এলসতীশবাবুদের এখনও আসার সময় হয়নিমূল দরজাটা খুলে সিড়িতে এসে দাঁড়াল সে। আকাশে লালচে আভা পুরাে মাত্রায় কিন্তু পৃথিবী ছায়ায় মাখামাখিআহা, কি আরামের সময় এখন। এইরকম যদি সারাটা দিন থাকত কি ভালই না হত।

সতীশবাবু বলেছেন শীতের সময় নাকি ঠাণ্ডাপ্রচণ্ড পডে এখানেসে ববং ভালআর এই শান্ত প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে দীপাবলীর মনে হল কাল সে শমিতকে নিয়ে একটা বাড়াবাড়ি ভাবনা করেছেঅন্তত তিরিকে জড়িয়ে ভাবনাটা বড় ছােট মনের পরিচয়। এমনটা সে ভাবল কি করে ? মানুষের রাগ কখন যে কোথায় টেনে নামায়, নামবার আগে তা বােঝা যায় না । শমিত আর যাই হােক পড়াশুনা করা সুস্থ নাটকের জন্যে আন্দোলন করিয়ে ছেলে। তার রুচি কখনই অমন স্তরে নামবে না। ভাবনাটা ভেবেছিল বলেই এখন লজ্জিত হল সে 

এইসময় বাবুদের আসতে দেখা গেল। দীপাবলীর মনে পড়ল সতীশবাবুর বাড়িতে অনুষ্ঠানের কথা । কাজের চাপে একদম মনেই ছিল না তারসে ঠিক করল, এখন কিছু বলবে না, আজ রাত্রে একাই ওঁর বাড়িতে গিয়ে অবাক করে দেবে। 

সাতকাহন পর্ব-(১৪)

ম্যাডাম, আপনি এখানে ?অক্ষয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন। ইচ্ছে হল এখানে দাঁড়াতেশীতকালে রােদ উঠলে এখানে দাঁড়াতে দেখবেন খুব ভাল লাগবে। ‘সতীশবাবু আসেননি

না তাে ! ওঁর বাড়িতে লােজন আছে, হয়তাে দেরিতে আসবেন। দীপাবলী কিছুতেই মনে করতে পারছিল না অনুষ্ঠান কবে ছিল, গতকাল না আজ ? যদি গতকাল হয়ে যায় তা হলে এদের প্রশ্ন করলে অপ্রস্তুত হতে হবেসে অফিসে ফিরে এসে অক্ষয়বাবুকে ডেকে পাঠাবেসতীশবাবুর পরেই অক্ষয়বাবুর অবস্থান। 

অক্ষয়বাবু, শুনেছেন নিশ্চয়ই, গতকাল মন্ত্রী এসে নেখালির অবস্থা দেখে গিয়েছেন। আমাদের আজই একটা কাজ করতে হবে। আমাদের ব্লকে যে কয়েকটা গ্রাম আছে তার একটা লিস্ট করে গ্রামপিছু তিনটে কুয়াে আর দুটো নলকূপ বসানাের খরচের একটা এস্টিমেট তৈরী করুন। আমি আজই পাঠাতে চাই, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। 

অক্ষয়বাবু ঘাড় নাড়লেন, ঠিক আছে, ম্যাডাম, একটা কথাবলুন। 

‘দুটো আজি ছিল। আমাদের এখানেও, মানে অফিসে আর আমাদের পাড়ায় দুটো নলকূপ ওর সঙ্গে জুড়ে দিই। আমাদেরও তাে জলের সমস্যা হচ্ছে। আমাদের এখানেও 

তাে সবসময় জল পাওয়া যায় না।” 

 

Read more

সাতকাহন পর্ব-(১৫)-সমরেশ মজুমদার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *