দীপাবলী একটু চিন্তা করল। অনুরােধটা অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু ওপরওয়ালা যদি মনে করে সে সুবিধে পেয়ে নিজেদের আরাম দেখছে তা হলে কথা উঠবে। উঠুক। এরা কাজ করবেন আর একটু আরামে থাকবেন না, তা কি করে হয় ?
শে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, সব শেষে দেবেন। দ্বিতীয়টা কি বলছিলেন ?
অক্ষয়বাবু বললেন, এদিকে তাে ইলেকট্রিক কবে আসবে কে জানে। অথচ মাত্র পাঁচ ক্রোশ দূরে ইলেকট্রিক রয়েছে। যদি লাইন টেনে আনা যায় ?
‘পাঁচ ক্রোশ ?’ হতভম্ব দীপাবলী, পাঁচ ক্রোশ লাইন করতে কত লাগবে জানেন ? এত খরচ সরকার করবে ? পাগল!
‘ওই পাঁচ ক্রোশ দূর পর্যন্ত আনতে অনেক ক্রোশ ডিঙোতে হয়েছিল তাে !
কথাটা বােধগম্য হওয়ামাত্র থমকে গেল দীপাবলী। কিছুদিন আগে একটি সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের যতটা অঞ্চলে সম্ভব হবে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত আর কাজ অবশ্য একসঙ্গে হচ্ছে না। এই অঞ্চলে ইলেকট্রিক এলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অন্তত পাম্প চালিয়ে জল ভােলা যাবে। পাঁচ ক্রোশ দূরত্ব সে ভেবেছিল নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠিতে, চমকে উঠেছিল সেই কাবণে । সরকারের কাছে ব্যাপারটা কিছু নয় বরং কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে । বাজেট অনুমােদন করলে সবই করা সম্ভব। সে বলল, “ঠিক আছে, দুটো আলাদা পােপােজাল করুন। একটার জন্যে দ্বিতীয়টা আবার বানচাল না হয়ে যায়।
ঠিক আছে ম্যাডাম।’ অক্ষয়ববু চলে গেলেন। এই ঘরে বসেই দীপাবলী শুনতে পাচ্ছিল অফিসঘরে উত্তেজনা চলছে। খােদ বিভাগীয় মন্ত্রী এই অফিসে এসে একটা দুপুর কাটিয়েছেন এটা যেন স্বপ্নের মত ব্যাপার। অনেকেই এর পর কি কি ভাল কাজ এই অঞ্চলে হবে তার আনুমানিক ফিরিস্তি দিচ্ছিল । ফাইলপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দীপাবলীর হঠাৎ অস্বস্তি হল। সতীশবাবু এখনও আসছেন না কেন ? ভদ্রলােক জ্বর গায়েও নাকি অফিস করেন। তিনি নিজেই বলেছেন বাড়িতে কাজ থাকলেও তিনি অফিসে আসবেন। অথচ ভদ্রলােক এলেন না।
সাতকাহন পর্ব-(১৫)
শেষপর্যন্ত অক্ষয়বাবুকে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করল। অক্ষয়বাবু বললেন, আপনাকে বলে যেতে সময় পাননি বােধ হয়, উনি শহরে গিয়েছে স্ত্রীকে নিয়ে।
খ্রীকে নিয়ে ? কেন ?
‘কাল সন্ধের পর ওঁর স্ত্রীর বুকে ব্যথা শুরু হয়। রাত্রে খুব বেড়ে যায়। আমাদের এখানে তাে ডাক্তার নেই। তাই মাঝরাত্রে গরুর গাড়ি যােগাড় করে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছেন শহরের হাসপাতালে।
‘গরুর গাড়ি ?
‘তা ছাড়া আর যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমরা বলেছিলাম সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। অর্জুনবাবুর কাছে গেলে জিপের ব্যবস্থা হত কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। অতক্ষণে বিনা চিকিৎসায় যদি কিছু হয়ে যায় !
‘তা তখনই অর্জনবাবুর কাছে গেলেন না কেন ?
অক্ষয়বাবু মুখ নিচু করেছিলেন, যাওয়া হয়েছিল। উনি রওনা হবার পরই কয়েকজন ছুটে গিয়েছিল সাইকেল নিয়ে জিপ পেলে মাইলখানেকের মধ্যেই ওঁদের ধরা ফেলা যেত। | ‘উনি জিপ দিলেন না ? . ‘না। তা নয়। উনি বলে দিলেন দুজন মহিলাকে পৌছে দিতে হবে খুব ভােরে আগে এই
কড়ারে তারা এসেছে অতএব তিনি জিপ শহরে পাঠাতে পারবেন না।
‘মহিলাকে ?
‘ম্যাডাম। ওর এসব অভ্যেসের কথা তাে সবাই জানে। উনি নিজেও আজকাল রাখঢাক করেন না। এমন বেপরােয়া লােক বড় একটা দেখা যায় না।
সাতকাহন পর্ব-(১৫)
“ঠিক আছে, আপনি কাজটা শেষ করুন। দীপাবলী মুখ ফেরাল। অক্ষয়বাবু চলে যেতে ঝিম মেরে বসে রইল সে কিছুক্ষণ। অর্জুন গত রাত্রে এখানে এসেছিল। তার নিশ্চয়ই একাধিক জিপ নেই। তা হলে ওই জিপে দুটি মহিলাকে একরাত্রের জন্যে আনিয়ে সে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু তাই বা কি করে হবে ? অজুন মীকে পােছে দিয়ে ফিরে আসতেই তাে ওর চেয়ে বেশি সময় লাগার কথা। তা হলে ওই সব মেয়েরা নিজেদের ব্যবস্থায় এসেছে অর্জুনের কাছে।
লােকটা এতখানি হৃদয়শূন্য যে একজন মারাত্মক অসুস্থ মানুষের কথা শুনেও নিজের জিপ দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হয়নি। তার চেয়ে সেই সব মেয়েদের পৌছে দেওয়া বড় হয়েছিল ?
দীপাবলী স্থির করল কোন অবস্থাতেই ওই লম্পট মানুষটাকে সে সাহায্য করবে না।
যতই সে মন্ত্রীর অনুগ্রহ পাক।অফিসে বসার পর শমিতের কথা একদম ভুলে ছিল দীপাবলী।
এর মধ্যে এক ফাঁকে তিরি এসে চা দিয়ে গিয়েছে। তখনও না।
নটা নাগাদ জলখাবার দিতে এলে খেয়াল হল।
সে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদাবাবু কোথায় রে ?
“উনি তাে সেই চা খেয়ে বেরিয়ে গেছেন ঝােলা নিয়ে। ‘ঝােলা নিয়ে ? চমকে উঠল দীপাবলী, ‘সুটকেস ?
‘না।
তিরি ঘন ঘন মাথা নাড়ল, ‘স্যুটকেস আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম জলখাবার খাবে কি না তাে বলল,না।
দুপুরে এলে ভাত খাবে? না এলে সেই ভাত রাত্রে।
কি গভীর হয়ে কথা বলছিল দিদি !
সাতকাহন পর্ব-(১৫)
‘ঠিক আছে, তুই ভেতরে যা। শমিত স্যুটকেস নিয়ে যায়নি শুনে কেন জানে না তার বেশ স্বস্তি হল । এসব জায়গায় বাইরের লােক বড় একটা আসে না। আর গ্রামের দিকে তাে নয়ই। তিনটে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে তবু ভােটের জন্যও কেউ প্রচার করতে যায়নি গ্রামে । অতএব ওরা শমিতকে কিভাবে নেবে তা ঈশ্বরই জানেন।
দশটায় ছুটি হবার মুখে একটা জিপের আওয়াজ শুনতে পেল সে।
তার মুখ গভীর হল ।
অকারণে অর্জুন নায়েককে সে এখানে বসতে দেবে না।
কিন্তু খানিক বাদেই
অক্ষয়বাবু এসে জানালেন, থানার দারােগাবাবু এসেছেন।
‘নিয়ে আসুন। তৎক্ষণাৎ গত রাত্রে শােনা অর্জুনের কথাগুলাে মনে পড়ল । সে শক্ত হল। এইটে এখনও তার অভ্যেসে রয়ে গেল। যা অপছন্দের তার মুখােমুখি হবার মুহূর্তে শরীরে কেমন কাঠ কাঠ ভাব এসে যায়।।
বিশাল ভুড়ি বেল্টের বাঁধনে থাকতে চাইছে না, চোখের তলায় কমলালেবুর কোয়ার মত মাংসের টিবি, মাথায় টাক, বগলে টুপি এবং হাতে লাঠি নিয়ে দারােগাবাবু প্রবেশ করে অনেকটা ঝুঁকে নমস্কার করলেন, ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম। আমাকে চিনতে পারছেন?
‘অবশ্যই। কষুন। গম্ভীর হতে চেষ্টা করল দীপাবলী।
চেয়ার টানলেন দারােগা শব্দ করেই। করে বসলেন, “আমার উচিত ছিল অনেক আগেই এখানে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু থানাটা এমন যে সমস্যা ছাড়া একটাও দিন কাটে না। আর আপনি যখন আমাকে ডেকে পাঠান না তখন বােঝা গেছে এখানে ঝামেলা নেই।
সাতকাহন পর্ব-(১৫)
‘তা নেই কিন্তু আপনার আর আমার নিয়মিত যােগাযােগ রাখা কর্তব্য এবং সেটার দায়িত্ব আপনারই। যাক গে, লে এসেছেন জানতে পারি?
না, তেমন কিছু না, কাটসি কল আর কি। কোন প্রকেম নেই তাে? ‘থাকলে তাে আপনি জানতে পারতেন। ‘হে যে, তা ঠিক। এস ডি ও সাহেব কিন্তু আমাকে খুব ভালবাসেন। “উনি তাে আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট।
তা হােক, পজিশনে তাে বড়। ‘দারােগাবাব, কাল সারাদিন আপনি কোথায় ছিলেন ?
এই কথাটা বলতেই তাে আপনার কাছে রােদ ভেঙে এলাম। ‘রােদ ভেঙে মানে ? ‘আঃ, এখানে দিন হল ঘুমানাের জন্যে আর রাত কাজের। যা শালা, সরি, গরম, দিনে কাজ করবে কে? আমি সারারাত কাজ করি আর দিনটাকে রাতের মত ভেবে নিই। এতে ম্যাজম বেশি কাজ করা যায়।
কিন্তু কাল দুপুরে আপনি থানায় ছিলেন ?
Read more