মিসির আলি বললেন, তোমাকে তো আমি একবার বলেছি আমি মাথায় তেল দেই না।মেয়েটি তারপরেও মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে হয় মাথায় তেল দিয়েই ছাড়বে। গ্রামের বাচ্চা একটা মেয়ের তুলনায় জেদ তো ভালোই আছে।মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, শোনো। তুমি কি তোমার বড় বাবার মাথায় রোজ তেল দিয়ে দিতে?
মেয়েটি খুবই বিস্মিত হলো। অবাক হয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে রইল।মিসির আলি বললেন, কীভাবে বললাম জানো? তুমি আমাকে বড় বাবা ডাকছি। আমার মাথায় তেল দিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। খুব সহজ অনুমান। আচ্ছা, শোনো, তোমার বাবা কি মারা গেছেন না বেঁচে আছেন? বাঁইচা আছেন।তুমি কি তোমার বাবার সঙ্গে থাকো?
হুঁ।তোমার সঙ্গে আর কে থাকে? আমরা তিন ভইন আর বড় বাবা।মিসির আলি বললেন, যাও, তেল নিয়ে এসে তেল দাও। কী তেল দেবে? ঘরে তো সয়াবিন তেল ছাড়া কোনো তেল নেই। সয়াবিন তেল কি মাথায় দেয়া যায়? নারিকেল তেল দিমু। আমি সাথে কইরা আনছি।তুমি তো দেখি খুবই গোছানো মেয়ে! মিসির আলির মেজাজ, সামান্য খারাপ হয়েছে। মেয়েটির ব্যাপারে তার বেশিরভাগ অনুমানই ঠিক হয় নি। কেমন কথা? তিনি কি আগের মতো চিন্তা করতে পারছেন না? বৃদ্ধ বয়সের স্থবিরতা তাঁকে গ্রাস করছে? এগিয়ে আসছে মহাশক্তিধর জরা?
মাথায় তেল দেওয়ার ব্যাপারটা এত আরামদায়ক তা তিনি জানতেন না। শারীরিক আরাম পেয়ে তার অভ্যাস নেই। কেউ একজন আরাম দিচ্ছে। আরাম নিতে অস্বস্তি লাগছে। সেই অস্বস্তিটা কাটাতে পারছেন না। কিন্তু আরামটা অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। আঁখিতারা মাথায় তেল দিতে দিতে টুকটুক করে কথা বলছে। কথাগুলি যে পরিষ্কার কানে আসছে তা না। তিনি কিছু শুনছেন। কিছু শুনছেন না। মাঝে মাঝে ই হাঁ করে যাচ্ছেন। কথার পিঠে কথা বলছেন। তাকে কথা না বললেও চলত। আঁখিতারা মিসির আলির জন্য অপেক্ষা করছে না। নিজের মনেই কথা বলছে।
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
আমার ব্যাপজান বাদাইম্যা।বাদাইম্যাটা কী? ঘর থাইক্যা চইল্যা যায়, ফিরে না। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস পরে ফিরে। চাইর-পাঁচ দিন থাকে, আবার চইল্যা যায়।সংসার চলে কীভাবে? চলে না। মা চিড়া কুটে, মুড়ি ভাজে, মুড়ি-লাডভু বানায়। আমি লুচি-লাডভু বানাইতে পারি। আমাকে ভেলিগুড় আইন্যা দিয়েন।
ভেলিগুড়টা কী?
ভেলিগুড় চিনেন না?
না।
কুষার থাইক্যা হয়। কুষার চিনেন?
না।
ইক্ষু চিনেন?
হুঁ। এখন বুঝেছি। আখের গুড়।আমরা চাইর ভাইনের মধ্যে সবচাইতে সুন্দর যে জন তার নাম নয়নতারা। আমার বড়। তিন বছরের বড়।তোমাদের সব বোনের নামের শেষেই তারা আছে নাকি? হুঁ। আমার পরেরটার নাম স্বৰ্ণতারা, তার পরের জনের নাম লজ্জাতারা।তোমরা দেখি তারা-পরিবার। ভাই হলে কী নাম হতো?
বাপজান সেইটাও ঠিক কইরা রাখছে। ভাই হইলে নাম হইত। তারা মিয়া। হি হি হি… আঁখিতারার হাসির মধ্যেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেও তাঁর চেতনার কিছু অংশ কাজ করতে লাগল। তিনি স্বপ্নে দেখছেন নৌকায় করে কোথাও যেন যাচ্ছেন। নৌকা খুব দুলছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। অথচ নৌকা ঠিকই যাচ্ছে। স্বপ্নের ভেতরও তিনি চিন্তিত বোধ করছেন। মাঝি নেই, নৌকা চলছে কীভাবে? স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছে?
নাকি নৌকায় পাল আছে? পালের নৌকার তো এত দ্রুত যাওয়ার কথা না। নাকি এটা ইনজিনের নৌকা? ইনজিনের নৌকা হলে ভটভট আওয়াজ আসত। কোনো আওয়াজ নেই। শুধুই ঝড়ের শব্দ।মিসির আলির ঘুম ভাঙল ঠিক সন্ধ্যায়। দুপুরে এত লম্বা ঘুম তিনি এর আগে ঘুমান নি। অসময়ের লম্বা ঘুম শরীর আউলে ফেলে, মাথায় ভোঁতা। যন্ত্রণা হয়। তার হচ্ছে। মাথার এই যন্ত্রণা কমানোর জন্য আবার ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঘুমের যন্ত্রণা ঘুম দিয়ে সারানো।
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
রান্নাঘরে খুঁটিখাট শব্দ হচ্ছে। আঁখিতারা মনে হয় রান্নাবান্নায় লেগে গেছে। তাকে কয়েকটা জিনিস শেখাতে হবে। চা বানানো। নানা রকম চা। দুধ চা, লিকার চা, আদা চা, মসলা চা, ঠাণ্ডা। চা।রাত ন’টার দিকে বাড়িওয়ালা আজমল সাহেব বেড়াতে এলেন। তাঁর আসার প্ৰধান উদ্দেশ্য আঁখিতারা কাজকর্ম কেমন করছে খোঁজ নেওয়া। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কাজের মেয়ে রাখতে হয় মারের ওপর। সকালে একটা থাপ্পড় দেবেন, সারাদিন ভালো থাকবে।
মাগরেবের নামাজের পর আবার থাপ্নড়, রাতটা আরামে কাটবে।মিসির আলি বললেন, মেয়েটা ভালো, থাপ্পড় দিতে হবে বলে মনে হয় না। আজমল সাহেব বললেন, গ্রামের পিচকা মেয়ে কখনো ভালো হয় না। মায়ের পেট থেকে এরা যখন বের হয় তাদের ভালো জিনিস সব মায়ের পেটে রেখে দিয়ে বের হয়। রান্নাবান্না কিছু জানে?
মনে হয় জানে।রেবুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন? দু-একটা আইটেম শিখিয়ে দেবে।রেবু রান্না জানে? খুব ভালো রান্না জানে। তার হাতে চিতলের পেটি খেলে বাকি জীবন মনে থাকবে।মিসির আলি বললেন, রেবুর ভালো নাম কি রাবেয়া? আজমল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভালো নাম রাবেয়া হবে কোন দুঃখে। ভালো নাম শেফালী। রেবু কি বলেছে তার ভালো নাম রাবেয়া? না।বলতেও পারে। মাথা ঠিক নাই। কখন কী বলে নিজেও জানে না।
আপনাকে বলে নাই তো তার বিবাহ হয়েছে? স্বামী তালাক দিয়ে চলে গেছে? জি না, এ রকম কিছু বলে নাই।আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, পাগলামি এমন এক অসুখ একবার হয়ে গেলে কখনো পুরোপুরি সারে না। অসুখের বীজ থেকেই যায়। ঠিকমতো আলো-হাওয়া পেলে বীজ থেকে গাছ হয়ে যায়? ঠিক বলেছি না ভাই সাহেব।মিসির আলি কিছু বললেন না। আজমল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, গত বৃহস্পতিবার সে তার মামীর সঙ্গে আপনাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে।মিসির আলি বললেন, কী বলেছে?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
বলেছে, আপনি নাকি তাকে বলেছেন, দুদিন পরপর তোমাকে দেখার জন্য পাত্ৰ পক্ষের লোকজন আসে। পছন্দ হয় না বলে ফিরত যায়। এত ঝামেলার দরকার কী? আমাকে বিয়ে করে ফেলো। তার মামী আবার তার কথা বিশ্বাসও করে ফেলেছে। মেয়েরা এই জাতীয় কথা দ্রুত বিশ্বাস করে। আমার কানে যখন কথাটা আসল আমি রেবুকে ডেকে কষে এক চড় লাগালাম। রেবু সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল যে মজা করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এইসব বলেছে।
বলেন কী! আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, সাধারণ মানুষের কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়। পাগলের কথা যে কান দিয়ে শুনবেন সেই কান দিয়েই বের করবেন। এক কান থেকে আরেক কানে যাওয়ার সময় দেবেন না, বুঝেছেন? মিসির আলি মাথা নেড়ে জানালেন যে বুঝেছেন। আজমল সাহেব হঠাৎ প্ৰসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, আপনি কি খাজা বাবার ডাক পেয়েছেন? মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কার ডাক?
খাজা বাবার, উনার ডাক পেয়েছেন?
আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
আজমল সাহেব বললেন, খাজা বাবা আজমীর থেকে না ডাকলে কেউ আজমীর শরিফ যেতে পারে না। আপনি কখনো আজমীর শরীফে গিয়েছেন? জি না।তার মানে ডাক পান নাই। আমি আগামী নভেম্বরে ইনশাল্লাহ। আজমীর যাব। চলেন আমার সঙ্গে। যাবতীয় খরচ আমার। ট্রেনে উঠে যদি একটা পান খেতে ইচ্ছা করে সেই পানটাও আমি কিনে দেব।
মিসির আলি জবাব দিলেন না। আজমল সাহেব বললেন, কথা ফাইনাল। না। করবেন না। আমি দু-তিন বছর অন্তর একবার করে খাজা বাবার কাছে। যাই। সমস্যা নিয়ে যাই। উনার রওজা মোবারকে উপস্থিত হয়ে সমস্যার ফানা চাই। উনি ব্যবস্থা করেন। আজ পর্যন্ত তার কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরত আসিনি।এইবার কী সমস্যা নিয়ে যাচ্ছেন?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
রেবুর সমস্যা নিয়ে যাচ্ছি। তার মাথাটা যেন ঠিক হয়ে যায়। তার একটা ভালো বিবাহ যেন দিতে পারি। ভাইজান, অনেক কথা বলে ফেললাম। আজমীরের ব্যাপারটা যেন মনে থাকে। জবান যখন দিয়ে ফেলেছি তখন আপনাকে নিয়ে যাবই। আর আমার পীর ভাই-এর সঙ্গেও আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিব। কথা বললেই বুঝবেন ইনি এই দুনিয়ার মানুষ না। উনাকে আপনার কথা বলেছি। উনিও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আজমল সাহেব উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনসুরের আসল নাম কি মিসির আলি ধরে ফেললেন। আজমল সাহেবের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে মনসুরের আসল নামের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু নামের ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার ঘটনা। এই সময়ই ঘটল।
মনসুরের আসল নাম চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া। সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার লেখা–সম্পাদকীয়, গল্প এবং রম্যরচনা তিনটিতেই বিশেষ একটা শব্দ দিয়ে বাক্য শুরুর প্রবণতা আছে। শব্দটা হলো ‘হয়তোবা’। মনসুর তাকে যে চিঠি লিখেছে সেই চিঠিতেও দুটি বাক্য শুরু হয়েছে হয়তোবা দিয়ে।
সোনার বাংলা পত্রিকার প্ৰিন্টার্স লাইনে পত্রিকার ডিক্লারেশন নাম্বার, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার সবই দেওয়া। বাংলাদেশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন-এ টেলিফোন করলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার সব খবর বের হয়ে আসবে। ছোট্ট একটা জটি খুললে অনেকগুলি জট খুলে যায়।রান্নাঘর থেকে আঁখিতারা উকি দিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, চা, বানাতে পারে?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
আঁখিতারা হাসি মুখে বলল, পারি।
কোথায় শিখেছি?
বাপজান খুব চা খায়।
কড়া করে এক কাপ চা বানাও। চিনি দেবে এক চামচ। সমান সমান করে এক চামচ দেবে কনডেন্সড মিল্ক।আঁখিতারা অতিদ্রুত চা বানিয়ে নিল। কাপে একটা চুমুক দিয়েই মিসির আলি বললেন, আজ থেকে তোমার নাম চা-কন্যা। আমি এত ভালো চা আমার জীবনে খাই নি।আতরের গন্ধে বাড়ি ম মা করছে।
আজমল সাহেবের পীর ভাই–হুজুরে কেবলা বিন নেশান আলি আসগর কুতুবী মিসির আলির বসার ঘরে বসে আছেন। আজমল সাহেব হুজুরে কেবলাকে এখানে বসিয়ে রেখে নাশতার জোগাড় করতে গেছেন। হুজুরে কেবল বসে আছেন মূর্তির মতো। মূর্তিও মাঝে মধ্যে বাতাসে এদিক-ওদিক দুলে–পীর ভাই-এর মধ্যে সেই দুলুনিও নেই।মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?
তিনি জবাব দিলেন না। তবে মিসির আলির দিকে তাকালেন। সামান্য হাসলেন।যিনি কথা বললে জবাব দেন না তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর প্রশ্ন ওঠে না। মিসির আলি চুপচাপ বসে রইলেন। আজমল সাহেব তাঁর পীর ভাইকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন এটা ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। হয়তো ধর্মের লাইনে মিসির আলিকে টানতে চান। সব মানুষই নিজের দিকে মানুষকে টানতে চায়। এক চোর অন্য একজনকে চোর বানাতে চেষ্টা করে। সাধু চেষ্টা করে সাধু বানাতে।
মিসির আলির সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। তার পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটও আছে। দেয়াশলাইও আছে। সিগারেট ধরালে এই পীর সাহেব কি মনে করেন তা বুঝতে পারছেন না বলেই সিগারেট ধরাচ্ছেন না।হুজুরে কেবল এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। তাঁর মাথাও খানিকটা ঝুকে এসেছে। থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। ভদ্রলোক কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৫
পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লে সিগারেট একটা ধরানো যেতে পারে। ভদ্রলোকের চোখের পাতা দেখতে পারলে মিসির আলি সহজেই ধরতে পারতেন। ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন কি-না। চোখের পাতা দেখা যাচ্ছে না।মিসির আলিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক হঠাৎ মাথা তুললেন। চোখ মেললেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন–কেমন আছেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব দেই নাই। কারণ তখন ওজিফা পাঠ করছিলাম। জবাব না দেওয়ায় আপনি হয়তো ভেবেছেন আমি বেয়াদবি করেছি। ইচ্ছাকৃত বেয়াদবি করি নি। আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনিচ্ছাকৃত বেয়াদবি করেছি–তার জন্যে ক্ষমা চাই।মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম।শুকরিয়া।মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম ঠিকই, আপনি কিন্তু এখনো প্রশ্নের জবাব দেন নি। এখনো বলেন নি কেমন আছেন।
Read more