তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ

এমন জটিল কোনও ধাধা না। এছাড়া আর কিছু কি আছে? আরেকবার পড়তে হবে। তবে যা পড়েছেন তাতে মেয়েটিকে খুঁজে বের করে ফেলার মত তথ্য আছে। ফারজানা মেয়েটি বােধ হয় তা জানে না। যেমন মেয়েটির বাবার নামে একটি হত্যা মামলা হয়েছিল।

তন্দ্রাবিলাসসেই মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আদালতের নথিপত্র ঘাটলেই বের হয়ে পড়বে। ডেড বডির পােস্টমর্টেম হয়েছিল। হাসপাতাল থেকেও সেই সম্পর্কিত কাগজ পত্র পাওয়া যাবে। একটু সময় সাপেক্ষ, তবে সহজ।। 

সেই সময়কার পুরানাে কাগজ ঘাটলেও অনেক খবর পাওয়া যাওয়ার কথা। ‘পাষন্ড স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন’ জাতীয় খবর পাঠক-পাঠিকারা খুব মজা করে পাঠ করেন। পত্রিকাওয়ালারা গুরুত্বের সঙ্গে সেই সব খবর ছাপেন। প্রথম পাতাতেই ছবি সহ খবর আসার কথা। তারপরের কয়েকদিন খবরের ফলাে আপ। | অবশ্যি বাংলাদেশে পুরানাে কাগজ ঘাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। যে ক’বার তিনি পরানাে কাগজ ঘাটতে গেছেন সে ক’বারই তার মাথা খারাপ হবার জোগাড় হয়েছে। বিদেশের মত ব্যবস্থা থাকলে ভাল হত। সব কিছু কম্পিউটারে ঢুকান, বােতাম টিপে বের করে নেয়া। 

মিসির আলি তার খাতা বের করলেন। কেইস নাম্বার দিয়ে ফারজানার নামে একটা ফাইল খােলা যেতে পারে। খাতার পাতায় ফারজানা নাম লিখতে গিয়ে মিসির আলি ইতস্তত করতে লাগলেন। ফাইল খােলার দরকার আছে কি? এখনও বােঝা যাচ্ছে না, ফারজানার লেখা সব ক’টা পাতা না পড়লে বােঝা যাবেও না। মিসির 

আলি পেনসিলে গােটা গােটা করে লিখলেন, 

নাম ফারজানা। বয়স  ২৩ 

রােগ ও স্কিজোফ্রেনিয়া ??? 

স্কিজোফ্রেনিয়া লিখে তিনবার প্রশ্নবােধক চিহ্ন দিলেন। ফারজানার লেখা যে ক’টি পাতা এখন পর্যন্ত পড়েছেন তা তিনি আরও তিনবার পড়বেন। তারপর ঠিক করবেন প্রশ্নবােধক চিহ্ন গুলি রাখবেন, কি রাখবেন না। সে যা লিখেছে তা সত্যি কি না তাও দেখার ব্যাপার আছে। সত্যি কথা না লিখলে তথ্যে ভুল থাকবে। প্রথম পাঠে তা ধরা পড়বে না। যত বেশি বার পড়া হবে ততই ধরা পড়তে থাকবে। তার নিজের নামটা সে যেমন কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার থেকে মনে হয় আরও অনেক নাম লেখার ভেতর লুকিয়ে আছে। সে গুলিও খুঁজে বের করতে হবে। তার মায়ের নাম কি চাপা? প্রিয় রঙ বলছে চাপা। আবার প্রিয় দুটি জিনিস চঁাদ এবং পানির প্রথম অক্ষর নিলেও চাপা হচ্ছে। এটা কাকতলীয়ও হতে পারে।

যদি কাকতলীয় না হয় তা হলে মেয়েটি তার সঙ্গে রহস্য করছে কেন? এই রহস্য করার জন্য তাকে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছে। এটা সে কেন করছে? ব্যাপারটা ছেলেমানুষী তাে বটেই। ফাইভ সিক্সে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এইসব করতে পারে। ২৩ বছরের একটা মেয়ে তুচ্ছ ধাধা তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করবে কেন? ব্যাপার কি এমন যে মেয়েটার কিছু করার নেই। দিনের পর দিন যারা বিছানায় শুয়ে থাকে তারা ক্রসওয়ার্ড পাজল, বা ব্রেইন টিজলার জাতীয় খেলায় আনন্দ পেতে পারে | এমন কি হতে পারে যে মেয়েটিকে দিনের পর দিন শুয়ে থাকতে হচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে হাতে পাতার পর পাতা লেখা কষ্টকর। সে লিখেছে ১০০ পৃষ্ঠা, লিখতে তার সময় লেগেছে ২ বছর। একটা পৃষ্ঠা লিখতে তার গড় পড়তা সময় লেগেছে সাতদিনের কিছু বেশি। লেখাগুলি লেখা হয়েছে কালির কলমে। চিৎ হয়ে শুয়ে কালির কলমে লেখা যায় না। তাকে লিখতে হয়েছে উপুর হয়ে। উপুর হয়ে যে লিখতে পারে সে বিছানায় পড়ে থাকার মত অসুস্থ না। কাজেই সে শয্যাশায়ী একজন রােগী এই হাইপােথিসিস বাতিল। 

মিসির তার খাতায় গুটি গুটি করে লিখলেন— ফারজানা মেয়েটি শারীরিক ভাবে সুস্থ। 

তিনি আরেকটি কাজও করলেন— ফারজানার একশ পৃষ্ঠার কোন অংশগুলি দিনে লেখা হয়েছে। কোনও অংশগুলি রাতে লেখা হয়েছে তা হলুদ মার্কার দিয়ে আলাদা করলেন। কাজটা জটিল মনে হলেও আসলে সহজ। রাতে আলাে কমে যায় বলে রাতের লেখায় অক্ষরগুলি সামান্য বড় হয়। এবং লেখা স্পষ্ট করার জন্যে কলমে চাপ দিয়ে লেখা হয়। দিনের লেখা এবং রাতের লেখা আলাদা করার তেমন 

কোনও কারণ নেই। তারপরেও করে রাখা— হঠাৎ যদি এর ভেতর থেকে কিছু বের হয়ে আসে। খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সঁচও পাওয়া যায় যদি ধৈর্য ধরে প্রতিটি খড়- একটি একটি করে আলাদা করা হয়। মিসির আলি তার অনুসন্ধানে ইনটিউশন যত না ব্যবহার করেন— পরিশ্রম তার চে অনেক বেশি ব্যবহার করেন। 

ছােট মা’কে আমি দেখতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম দু’দিন, তিন দিন পর পর হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে দেখা যেত। তারপর রােজ-ই দেখতে পেতাম।। 

শুরুতে তিনি আমার সঙ্গে কোনও কথা বলতেন না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ শুনতেন। তারপর কথা বলা শুরু করলেন। কথা বলতেন ফিস ফিস করে। কোথাও কোনও শব্দ হলে দারুণ চমকে উঠতেন। 

হয়ত বাতাসে দরজা নড়ে উঠল– সেই শব্দে মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে চলে গেলেন পর্দার আড়ালে। ছােট মা’র দেখা পাওয়াটা ঠিক স্বাভাবিক ব্যাপার না এটা আমার বােধের ভেতর ছিল। আমি এর বাইরেও কিছু কিছু ব্যাপার লক্ষ করলাম। যেমন ছােট মা কখনও কিছু খান না। আমি কমলা সেধেছি! প্লেট থেকে কেক তুলে দিয়েছি। তিনি কখনও কিছু মুখে দেন নি। তিনি যখন আশে পাশে থাকতেন তখন আমি এক ধরনের গন্ধ পেতাম। মিষ্টি গন্ধ, তবে ফুলের গন্ধ না। ওষুধ ওষুধ গন্ধ। 

আসল ছােট মা’র সঙ্গে এই মায়ের কিছু অমিলও ছিল। যেমন ছােট মা আমাকে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডাকতেন। ইনি ডাকতেন না। একদিন আমি নিজেই বললাম, তুমি ঐ নামগুলি বল না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন নাম ? 

তা থেকে বুঝলাম নামগুলি তিনি জানেন না। 

ছােটরাও নিজেদের মত করে কিছু পরীক্ষা-টরীক্ষা করে। আমিও ছােট মা’কে নিয়ে কিছু পরীক্ষা করলাম—যেমন একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তােমার নাম কি ? 

ছােট মা বললেন, জানি না তাে। আমি বললাম, সত্যি জান না ? তিনি বললেন, না। আমার কি নাম ? 

আমি বললাম, তােমার নাম চাপা। 

তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? আমার সামান্য খটকা লাগলেও আমি নির্বিকার ছিলাম। একজন খেলার সাথি পেয়েছি, এই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল।। 

ছােট মা খেলার সঙ্গী হিসেবে চমৎকার ছিলেন। যা বলা হত তাই রােবটের মত করতেন। কোন প্রশ্ন করতেন না। মা’দের ভেতর খবরদারির একটা ব্যাপার থাকে। ওনার ভেতর তা ছিল না। 

পায়ে মােজা নেই কেন? ঘর নােংরা করছ কেন? ঘুমুতে যাচ্ছ না কেন? 

এ জাতীয় প্রশ্ন করে তিনি আমাকে কখনও বিব্রত করতেন না। আমার বেশ ক’জন টিচার ছিলেন। পড়ার টিচার, গানের টিচার, নাচের টিচার। তারা যখন আসতেন- নীচ থেকে ইন্টারকমে আমাকে বলা হত। আমি নীচে যাবার জন্যে তৈরি হতাম। মাকে সেই সময় খুব বিব্রত মনে হত। তিনি যেন ঠিক বুঝতে পারছেন 

কি করবেন। তাঁকে খুব কাদতেও দেখতাম। দুহাতে মুখ ঢেকে খুন খুন করে কাঁদতেন। চোখ দিয়ে তখন অবশ্যি পানি পড়ত না। তার কান্না সব সময় ছিল অশ্রুবিহীন। 

মিসির আলি সাহেব আপনি আমার সামনে নেই বলে আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে। হয়ত আপনার মনে অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে, কিন্তু আপনি প্রশ্নগুলি করতে পারছেন না। সামনা সামনি থাকলে প্রশ্ন করতে পারতেন। আর আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না— কোনও ডিটেল বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না। গুরুত্বহীন মনে করে আমি হয়ত অনেক কিছু লিখছি না—যা আপনার কাছে মােটেই গুরুত্বহীন না। তবু আপনার মনে সম্ভাব্য যে সব প্রশ্ন আসছে বলে আমার ধারণা—আমি তার জবাব দিচ্ছি। 

প্রশ্ন ৪ ওনার গায়ে কি পােষাক থাকত ? 

উত্তর ও সাধারণ পােষাক। শাড়ি। যে সব শাড়ি আগে পরতেন সেই সব শাড়ি। 

প্রশ্ন ও উনি কি হঠাৎ উপস্থিত হতেন এবং পরে বাতাসে মিলিয়ে যেতেন ? 

উত্তর ঃ না। কখনও হঠাৎ উদয় হতেন না। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেন। বের হয়ে যাবার সময়ও দ্রজা খুলে বের হয়ে যেতেন। তার পুরাে ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। তাকে আমি কখনও শূন্যে ভাসতে দেখিনি কিংবা লম্বা একটা 

হাত বের করে দূর থেকে কিছু আনতে দেখিনি। 

প্রশ্ন ঃ তুমি নিশ্চিত যে উনি তােমার ছােট মা? 

উত্তর জি নিশ্চিত। তবে আগেই তাে বলেছি—আমার চেনা ছােটমা’র সঙ্গে তার কিছু অমিল ছিল—যেমন তিনি পড়তে পারতেন না। অথচ ছােট মা আমাকে রােজ রাতে গল্পের বই পড়ে শুনাতেন। কাজেই আমি একদিন উনাকে গল্পের বই পড়ে শুনাতে বললাম। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন যে তিনি বই পড়তে জানেন না। তিনি আমাকে বই পড়া শেখাতে বললেন। 

প্রশ্ন তুমি তাকে বই পড়া শেখালে ? উত্তর ঃ জ্বি। উনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন। প্রশ্ন ও উনি কি তােমার জন্যে কখনও কোনও উপহার নিয়ে এসেছেন? উত্তর ঃ জ্বি এনেছেন। প্রশ্ন ঃ কি উপহার ? উত্তর ঃ সেটা আমি আপনাকে বলব না। প্রশ্ন ঃ তুমি ছাড়া আর কেউ কি ওনাকে দেখেছে? উত্তর ঃ জ্বি না। প্রশ্ন ও তাকে দিনে বেশি দেখা যেত, না রাতে? উত্তর ঃ দিন রাত কোন ব্যাপার ছিল না। প্রশ্ন ও সব সময়ই কি একই কাপড় পরা থাকতেন ? উত্তর ঃ জি না। একেক সময় একেক কাপড় পরা থাকত। প্রশ্ন ঃ তিনি তােমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করতেন? উত্তর ঃ জ্বি করতেন। মাঝে মাঝে আমি তার কোলে উঠে বসে থাকতাম। 

যে সব প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছে তার উত্তর দিলাম। অনেক চিন্তা করেও আর কোন প্রশ্ন পাচ্ছি না। আপনারা যারা সাইকিয়াট্রিস্ট তারা তাে রাজ্যের প্রশ্ন করেন। উদ্ভট সব প্রশ্ন। আপনার মাথাতেও নিশ্চয়ই উদ্ভট সব প্রশ্ন আসছে। ও না ভুল করলাম— আপনি তাে আবার অন্যদের মত না। আপনি প্রশ্ন করেন না। শুধু শুনে যান। একই গল্প বার বার শােনেন। শুনতে শুনতে হঠাৎ এক জায়গায় খটকা লাগে। যেখান থেকে আপনার যাত্রা শুরু হয়। আমার গল্পে কোথাও কি কোনও খটকা লেগেছে ? নাকি পুরাে গল্পই খটকাময়’? পুরাে গল্প খটকাময় হলে তাে আপনি কাগজগুলি ছুঁড়ে ফেলে বলবেন– আরে দূর দূর। 

প্লীজ তা করবেন না। আমার অনেক কিছু বলার আছে। Please Help Me. 

আপনি নিশ্চয়ই এখন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। ভাবছেন মেয়েটার কি কন্ট্রাডিকশান—সাহায্য চাচ্ছে, আবার কোনও ঠিকানা দিচ্ছে না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *