বিলু এমন মেয়ে, যার ওপর কখনাে রাগ করা যায় না। নীলু কখনাে রাগ করতে পারে না। মাঝে–মাঝে বাবা দুই–একটা কড়া কথা বলেন। তখন বিলু রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে এক মহা যন্ত্রণা! একবার রাগ করে সে পুরাে দুদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিল। কত সাধাসাধি, কত অনুরােধ! শেষ পর্যন্ত মগবাজারের ছােটমামাকে আনতে হলাে।
ছােটমামা বিলুর খুব খাতিরের মানুষ। তার সব কথা সে শােনে। তিনি এসে যখন বললেন, ‘দরজা না খুললে মা আমি কিন্তু আর আসব না। এই আমার শেষ আসা–‘ তখন দরজা খুলল। এ রকম জেদী মেয়ে।
নীলুর কোনাে জেদ–টেদ নেই। কালাে এবং অসুন্দরী মেয়েদের জেদ কখনাে থাকে না। এদের জীবন কাটাতে হয় একাকী । নীলু বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করল। ছােটবেলার বাতি নেভানাের সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম আসত, এখন আর আসে।
অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ–ওপাশ করতে হয়।
পাশের খাটে টেবিল–ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ওপর একটা গল্পের বই ধরে আছে বিলু। অনেক রাত পর্যন্ত সে পড়বে। পড়তে–পড়তে হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে, বাতি নেভাবে না। মশারি ফেলবে না। নীলুকেই উঠে এসে বাতি নেভাতে হবে, মশারি ফেলতে হবে।
‘বিলু ঘুমাে, বাতি নেভা।
একটু পরে ঘুমাব। কী পড়ছিস?” ‘শীর্ষেন্দুর একটা বই। দারুণ!‘ ‘দিনে পড়িস। আলাে চোখে লাগছে।‘ ‘দিনে আমার সময় কোথায়? তুমি ঘুমাও–না!‘
নীলু ঘুমাতে পারল না। শুয়ে–শুয়ে তাকিয়ে রইল বিলুর দিকে। দিনে–দিনে কী যে সুন্দর হচ্ছে মেয়েটা! একই বাবা–মার দুই মেয়ে একজন এত সুন্দর আর অন্য জন এত অসুন্দর কেন? নীলু ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘আপা?” কী?” দারুণ বই, তুমি পড়ে দেখ। প্রেমের?”
হ্যা। প্রেমের হলেও খুব সিরিয়াস জিনিস। দারুণ! “তাই নাকি?” ‘হু, একজন খুব রূপবতী মেয়ের গল্প। | তাের মতাে একজন?”
‘দূর, আমি আবার সুন্দর নাকি? আমাদের তিনতলার ভাড়াটের বৌটির মতাে বলতে পার । রানু নাম, দেখেছ?
তাে, খুব সুন্দরী? “ওরে বাপ, দারুণ! হেমা মালিনীর চেয়েও সুন্দরী। ‘তুই মেয়েটিকে এক বার আসতে বলিস তাে আমাদের বাড়িতে! দেখব।‘
বলব। তুমি নিজে এক বার গেলেই পার। মেয়েটা ভালাে। কথাবার্তায় খুব ভদ্র। ওর বরকে দেখেছ, আনিস সাহেব?”
‘ঐ লােকটা বােকা ধরনের। বােকার মতাে কথাবার্তা। আমাকে আপনি আপনি করে বলে।
কলেজে পড়িস, তােকে আপনি বলবে না? ফ্রক–পরা কাউকে এ রকম এক জন বুড়াে মানুষ আপনি বলবে নাকি? বুড়াে নাকি?” ‘চল্লিশের ওপর বয়স হবে। ‘মেয়েটার বয়স কত? ‘খুব কম। চোদ্দ–পনের হবে।
বিলু বাতি নিভিয়ে দিল এবং নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ল। নীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। কিছুতেই তার ঘুম এল না। ইদানীং তার ঘুম খুব কমে গেছে। রােজই মাঝরাত না হওয়া অবধি ঘুম আসে না।
রানু চুলায় ভাত চড়িয়ে বসার ঘরে এসে দেখে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি ঘরের ভেতর।
না জিজ্ঞেস করেই ঢুকে পড়লাম ভাই। আমার নাম নীলু।
‘আসুন, আসুন। আপনাকে আমি চিনি। আপনি বাড়িঅলার বড় মেয়ে। আজ ইউনিভার্সিটি যান নি?‘
“উঁহু। আজ ক্লাস নেই। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। কী করছিলেন?
ভাত রান্না করছি।‘ চলুন, রান্নাঘরে গিয়ে বসি। বিলুর কাছ থেকে আপনার খুব প্রশংসা শুনি।
বিলুর ধারণা, আপনি হচ্ছেন হেমা মালিনী।।
রানু অবাক হয়ে বলল, “হেমা মালিনীটি কে?
আছে একজন। সিনেমা করে। সবাই বলে খুব সুন্দর। আমার কাছে সুন্দর লাগে না। চেহারাটা অহঙ্কারী।‘
রানু মুখ টিপে হাসতে–হাসতে বলল, ‘সুন্দরী মেয়েরা তাে অহঙ্কারীই হয়।
আপনিও অহঙ্কারী?
রানু হাসতে হাসতে বলল, হ্যা। কিন্তু আমাকে আপনি আপনি বলতে পারবেন না। তুমি করে বলতে হবে।
নীলু লক্ষ্য করল মেয়েটি বেশ রােগা কিন্তু সত্যিই রূপসী। সচরাচর দেখা যায় না। চোখ দুটি কপালের দিকে ওঠান বলে—দেবী–প্রতিমার চোখের মতাে লাগে। সমগ্র চেহারায় খুব সূক্ষ্ম হলেও কোথাও যেন একটি মূর্তি–মূর্তি ভাব আছে।
কী দেখছেন?” ‘তােমাকে দেখছি ভাই। তােমার চেহারায় একটা মূর্তি–মূর্তি ভাব আছে।
রানু মুখ কালাে করে ফেলল। নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘ও কী! তুমি মনে হয় মন–খারাপ করলে?‘
, মন–খারাপ করব কেন?‘ ‘কিন্তু এমন মুখ কালাে করলে কেন? আমি কিন্তু কমপ্লিমেন্ট হিসেবে তােমাকে বলেছি। তােমার মতাে সুন্দরী মেয়ে আমি খুব বেশি দেখি নি। তবে এক বার একটি বিহারি মেয়েকে দেখেছিলাম। আমার ছােটমামার বিয়েতে। অবশ্যি সে মেয়েটি তােমার মতাে রোগা ছিল না। ওর স্বাস্থ্য বেশ ভালাে ছিল।‘
‘আপনি কি একটু চা খাবেন?”
তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? তােমার কি মনে হয় আমার বয়স অনেক বেশি?
না, তা মনে হয় না। ‘তুমিও আমাকে তুমি বলবে। আর তােমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি মাঝে–মাঝে তােমার কাছে আসব।‘
রানু চায়ের কাপ সাজাতে–সাজাতে মৃদু স্বরে বলল, আমাকে মূর্তি–মূর্তি লাগে, এটা বললে কেন?‘
নীলু অবাক হয়ে বলল, “এমনি বলেছি! টানাটানা চোখ তাে, সে জন্যে। তুমি দেখি ভাই রাগ করেছ।
একটা কারণ আছে নীলু। তােমাকে আমি এক দিন সব বলব, তাহলেই বুঝবে । চায়ে কতটুকু চিনি খাও?
‘তিন চামচ।
নীলু অনেকক্ষণ বসল, কিন্তু কথাবার্তা আর তেমন জমল না। রানু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কিছুতেই মন লাগাতে পারছে না। সহজ হতে পারছে না। নীলু বেশ কয়েক বার অন্য প্রসঙ্গ আনতে চেষ্টা করল। ভাসা–ভাসা জবাব দিল রানু। এবং একসময় হালকা স্বরে বলল, আমার একটা অসুখ আছে নীলু।
“কি অসুখ?” মাঝে–মাঝে আমি ভয় পাই।’ ‘ভয় পাই মানে?”
রানু মাথা নিচু করে বলল, “ছােটবেলায় এক বার নদীতে গােসল করতে গিয়েছিলাম, তার পর থেকে এ রকম হয়েছে।‘
কী হয়েছে?” রানু জবাব দিল না। বিল, কী হয়েছে? ‘অন্য এক দিন বলব। আজ তুমি তােমার কথা বল। ‘আমার তাে বলার মতো কোনাে কথা নেই। “তােমার বন্ধুদের কথা বল।
‘আমার তেমন কোনাে বন্ধুও নেই। আমি বলতে গেলে একা–একা থাকি। অসুন্দরী মেয়েদের বন্ধুটন্ধু থাকে না।
‘রঙ খারাপ হলে মানুষ অসুন্দর হয় না নীলু। ‘আমি নিজে কী, সেটা আমি ভালােই জানি।‘ নীলু উঠে পড়ল। রানু বলল, আবার আসবে তাে?” “আসব। তুমি তােমার ভয়ের কথাটথা কি বলছিলে, সেই সব বলবে।‘
বলব।‘
নীল পাঠাবে না পাঠাবে না করেও চিঠিটি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু তার পরপরই দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। কে জানে, বুড়াে–হাবড়া লােকটি এক দিন হয়তাে বাসায় এসে হাজির হবে। দারুণ লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। নিতান্তই ছেলেমানুষি কাজ করা হয়েছে। চার–পাঁচ দিন নীলুর খুব খারাপ কাটল। দারুণ অস্বস্তি। বুড়ােমতাে কোনাে মানুষকে আসতে দেখলেই চমকে উঠত, এটিই সেই লােক নাকি? যদি সত্যি–সত্যি কেউ এসে পড়ে, তাহলে সে ভেবে রেখেছে বলবে—এই চিঠি তাে আমার নয়। অন্য কেউ তামাশা করে এই ঠিকানা দিয়েছে। আমি এ রকম অজানা–অচেনা কাউকে চিঠি লিখি না।