দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

 বিলু এমন মেয়ে, যার ওপর কখনাে রাগ করা যায় নানীলু কখনাে রাগ করতে পারে নামাঝেমাঝে বাবা দুইএকটা কড়া কথা বলেনতখন বিলু রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়সে এক মহা যন্ত্রণা! একবার রাগ করে সে পুরাে দুদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিলকত সাধাসাধি, কত অনুরােধ! শেষ পর্যন্ত মগবাজারের ছােটমামাকে আনতে হলাে

ছােটমামা বিলুর খুব খাতিরের মানুষতার সব কথা সে শােনেতিনি এসে যখন বললেন, দরজা না খুললে মা আমি কিন্তু আর আসব নাএই আমার শেষ আসাতখন দরজা খুললরকম জেদী মেয়ে। 

নীলুর কোনাে জেদটেদ নেইকালাে এবং অসুন্দরী মেয়েদের জেদ কখনাে থাকে নাএদের জীবন কাটাতে হয় একাকী নীলু বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করলছােটবেলার বাতি নেভানাের সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম আসত, এখন আর আসে

অনেক রাত পর্যন্ত এপাশওপাশ করতে হয়। 

পাশের খাটে টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ওপর একটা গল্পের বই ধরে আছে বিলুঅনেক রাত পর্যন্ত সে পড়বেপড়তেপড়তে হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে, বাতি নেভাবে নামশারি ফেলবে নানীলুকেই উঠে এসে বাতি নেভাতে হবে, মশারি ফেলতে হবে। 

বিলু ঘুমাে, বাতি নেভা। 

একটু পরে ঘুমাবকী পড়ছিস?শীর্ষেন্দুর একটা বইদারুণ!দিনে পড়িসআলাে চোখে লাগছে‘দিনে আমার সময় কোথায়? তুমি ঘুমাওনা!‘ 

নীলু ঘুমাতে পারল নাশুয়েশুয়ে তাকিয়ে রইল বিলুর দিকেদিনেদিনে কী যে সুন্দর হচ্ছে মেয়েটা! একই বাবামার দুই মেয়ে একজন এত সুন্দর আর অন্য জন এত অসুন্দর কেন? নীলু ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। 

আপা?কী?দারুণ বই, তুমি পড়ে দেখপ্রেমের?” 

হ্যাপ্রেমের হলেও খুব সিরিয়াস জিনিসদারুণ! তাই নাকি?হু, একজন খুব রূপবতী মেয়ের গল্প| তাের মতাে একজন?” 

দূর, আমি আবার সুন্দর নাকি? আমাদের তিনতলার ভাড়াটের বৌটির মতাে বলতে পার রানু নাম, দেখেছ

তাে, খুব সুন্দরী? ওরে বাপ, দারুণ! হেমা মালিনীর চেয়েও সুন্দরীতুই মেয়েটিকে এক বার আসতে বলিস তাে আমাদের বাড়িতে! দেখব‘ 

বলবতুমি নিজে এক বার গেলেই পারমেয়েটা ভালােকথাবার্তায় খুব ভদ্রওর বরকে দেখেছ, আনিস সাহেব?” 

লােকটা বােকা ধরনেরবােকার মতাে কথাবার্তাআমাকে আপনি আপনি করে বলে

কলেজে পড়িস, তােকে আপনি বলবে না? ফ্রকপরা কাউকে রকম এক জন বুড়াে মানুষ আপনি বলবে নাকি? বুড়াে নাকি?চল্লিশের ওপর বয়স হবেমেয়েটার বয়স কত? খুব কমচোদ্দপনের হবে। 

বিলু বাতি নিভিয়ে দিল এবং নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়লনীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্তকিছুতেই তার ঘুম এল নাইদানীং তার ঘুম খুব কমে গেছেরােজই মাঝরাত না হওয়া অবধি ঘুম আসে না। 

রানু চুলায় ভাত চড়িয়ে বসার ঘরে এসে দেখে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি ঘরের ভেতর। 

না জিজ্ঞেস করেই ঢুকে পড়লাম ভাইআমার নাম নীলু। 

আসুন, আসুনআপনাকে আমি চিনিআপনি বাড়িঅলার বড় মেয়েআজ ইউনিভার্সিটি যান নি?‘ 

উঁহুআজ ক্লাস নেইআপনার সঙ্গে গল্প করতে এলামকী করছিলেন

ভাত রান্না করছিচলুন, রান্নাঘরে গিয়ে বসিবিলুর কাছ থেকে আপনার খুব প্রশংসা শুনি। 

বিলুর ধারণা, আপনি হচ্ছেন হেমা মালিনী। 

রানু অবাক হয়ে বলল, হেমা মালিনীটি কে

আছে একজনসিনেমা করেসবাই বলে খুব সুন্দরআমার কাছে সুন্দর লাগে নাচেহারাটা অহঙ্কারী‘ 

রানু মুখ টিপে হাসতেহাসতে বলল, ‘সুন্দরী মেয়েরা তাে অহঙ্কারীই হয়। 

আপনিও অহঙ্কারী

রানু হাসতে হাসতে বলল, হ্যাকিন্তু আমাকে আপনি আপনি বলতে পারবেন নাতুমি করে বলতে হবে। 

নীলু লক্ষ্য করল মেয়েটি বেশ রােগা কিন্তু সত্যিই রূপসীসচরাচর দেখা যায় নাচোখ দুটি কপালের দিকে ওঠান বলেদেবীপ্রতিমার চোখের মতাে লাগেসমগ্র চেহারায় খুব সূক্ষ্ম হলেও কোথাও যেন একটি মূর্তিমূর্তি ভাব আছে। 

কী দেখছেন?” তােমাকে দেখছি ভাইতােমার চেহারায় একটা মূর্তিমূর্তি ভাব আছে। 

রানু মুখ কালাে করে ফেললনীলু অবাক হয়ে বলল, কী! তুমি মনে হয় মনখারাপ করলে?‘ 

, মনখারাপ করব কেন?কিন্তু এমন মুখ কালাে করলে কেন? আমি কিন্তু কমপ্লিমেন্ট হিসেবে তােমাকে বলেছিতােমার মতাে সুন্দরী মেয়ে আমি খুব বেশি দেখি নিতবে এক বার একটি বিহারি মেয়েকে দেখেছিলামআমার ছােটমামার বিয়েতেঅবশ্যি সে মেয়েটি তােমার মতাে রোগা ছিল নাওর স্বাস্থ্য বেশ ভালাে ছিল‘ 

আপনি কি একটু চা খাবেন?” 

তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? তােমার কি মনে হয় আমার বয়স অনেক বেশি

না, তা মনে হয় নাতুমিও আমাকে তুমি বলবেআর তােমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি মাঝেমাঝে তােমার কাছে আসব।‘ 

রানু চায়ের কাপ সাজাতেসাজাতে মৃদু স্বরে বলল, আমাকে মূর্তিমূর্তি লাগে, এটা বললে কেন?‘ 

নীলু অবাক হয়ে বলল, এমনি বলেছি! টানাটানা চোখ তাে, সে জন্যেতুমি দেখি ভাই রাগ করেছ। 

একটা কারণ আছে নীলুতােমাকে আমি এক দিন সব বলব, তাহলেই বুঝবে চায়ে কতটুকু চিনি খাও

তিন চামচ। 

নীলু অনেকক্ষণ বসল, কিন্তু কথাবার্তা আর তেমন জমল নারানু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেকিছুতেই মন লাগাতে পারছে নাসহজ হতে পারছে নানীলু বেশ কয়েক বার অন্য প্রসঙ্গ আনতে চেষ্টা করলভাসাভাসা জবাব দিল রানুএবং একসময় হালকা স্বরে বলল, আমার একটা অসুখ আছে নীলু। 

কি অসুখ?মাঝেমাঝে আমি ভয় পাই।’ ভয় পাই মানে?” 

রানু মাথা নিচু করে বলল, ছােটবেলায় এক বার নদীতে গােসল করতে গিয়েছিলাম, তার পর থেকে রকম হয়েছে‘ 

কী হয়েছে?রানু জবাব দিল নাবিল, কী হয়েছে? অন্য এক দিন বলবআজ তুমি তােমার কথা বলআমার তাে বলার মতো কোনাে কথা নেইতােমার বন্ধুদের কথা বল। 

আমার তেমন কোনাে বন্ধুও নেইআমি বলতে গেলে একাএকা থাকিঅসুন্দরী মেয়েদের বন্ধুটন্ধু থাকে না। 

রঙ খারাপ হলে মানুষ অসুন্দর হয় না নীলুআমি নিজে কী, সেটা আমি ভালােই জানিনীলু উঠে পড়লরানু বলল, আবার আসবে তাে?আসবতুমি তােমার ভয়ের কথাটথা কি বলছিলে, সেই সব বলবে‘ 

বলব‘ 

নীল পাঠাবে না পাঠাবে না করেও চিঠিটি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু তার পরপরই দুশ্চিন্তার সীমা রইল নাকে জানে, বুড়ােহাবড়া লােকটি এক দিন হয়তাে বাসায় এসে হাজির হবেদারুণ লজ্জার ব্যাপার হবে সেটানিতান্তই ছেলেমানুষি কাজ করা হয়েছেচারপাঁচ দিন নীলুর খুব খারাপ কাটলদারুণ অস্বস্তিবুড়ােমতাে কোনাে মানুষকে আসতে দেখলেই চমকে উঠত, এটিই সেই লােক নাকি? যদি সত্যিসত্যি কেউ এসে পড়ে, তাহলে সে ভেবে রেখেছে বলবেএই চিঠি তাে আমার নয়অন্য কেউ তামাশা করে এই ঠিকানা দিয়েছেআমি রকম অজানাঅচেনা কাউকে চিঠি লিখি না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *