মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ

মধ্যাহ্ন

আকাশে মেঘ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছেঘােমটা পরা তরুণী দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর নাম জুলেখাএকসময় সে অস্ফুট স্বরে বলল, কী সৌন্দর্য গাে! কী সৌন্দর্য!মধ্যাহ্ন ঠিক একই সময় জুলেখার বয়সি একটা মেয়েও জাহাজে করে আটলান্টিক পার হচ্ছিলসে একা একা জাহাজের ডেকে বসেছিলসেও মহাসাগরের শােভা দেখে জুলেখার মতােই মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিলকী সুন্দর! কী সুন্দর

মেয়েটি নােবেল পুরস্কার বিজয়ী মাদাম কুরিতিনি রেডিও অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করেছেনআমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ট্রাস্টের আমন্ত্রণে বেড়াতে যাচ্ছেন আমেরিকায়| আমাদের জুলেখার সেই বৎসর স্থান হলাে কেন্দুয়ার বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতেস্থানীয় ভাষায় যার নাম রঙিলা নটিবাড়ি। 

Encyclopedia Britanicaপ্রাচীন সংস্করণে কেন্দুয়ার উল্লেখ ছিলসেখানে লেখা ছিল Kendua a place for dancing girls. আনন্দদায়িনী নর্তকীদের মিলনমেলা। 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ

রঙিলা নটিবাড়ি সােহাগগঞ্জ বাজারের শেষ মাথায়মাছের আড়ত পার হয়েও আটদশ মিনিট হাঁটতে হয়রাস্তার দুপাশে আপনাতে গজিয়ে ওঠা বেশকিছু শিমুলগাছযেকেউ দেখে ভাববে কোনাে এক বৃক্ষপ্রেমী চিন্তাভাবনা করে শিমুলের সারি লাগিয়েছেনচৈত্রমাসে শিমুলের টকটকে লাল ফুল ফোটে দেখতে ভালাে লাগেমনে হয় চৈত্রের তীব্র উত্তাপে গাছের মাথায় আগুন লেগে গেছে। 

মূল বাড়ি কাঠের উপরে টিনমূল বাড়ি ঘিরে এক রুমের বেশ কিছু ছােট ছােট ঘরকাঠের মূল বাড়িটা দর্শনীয় উচ্চতায় প্রায় দোতলা বাড়ির সমানদরজা এবং পাল্লায় ফুল লতাপাতা আঁকাটিনের চৌচালাতেও নকশা কাটালখনৌ-এর বাইজি আংগুরি অনেক টাকাপয়সা খরচ করে মূল বাড়ি তৈরি করেএই বাড়িতে তার একটা কন্যাসন্তান হয়তার নাম বেদানাতিন বছর বয়সে বেদানা পানিতে ডুবে মারা যায়বেদানার মৃত্যুর পর আংগুরির আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায় নিকেউ বলে আংগুরিও মেয়ের মতাে পানিতে ডুবে গেছেআবার কারাে কারাে মতে আংগুরি দেশান্তরী হয়েছে। 

দেশান্তরীশব্দটা এলাকার মানুষের অতি প্রিয়স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই স্বামীরা বলে, দেশান্তরী হবাে, আসাম চলে যাবদেশান্তরী হয়ে আসাম চলে যাবার বাসনার কারণআসাম খুব দূরের দেশ নাবনজঙ্গল পাহাড়পর্বতের অঞ্চলসেখানেই আছে কামরূপ কামাক্ষ্যাজাদুবিদ্যার দেশকামরূপ কামাক্ষ্যার অতি রূপবতী নারীরা পুরুষদের বশ করে চিরদিনের জন্যে রেখে দিতে পছন্দ করে। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে গেলে ফেরা হয় না সেই কারণেই। 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ

জুলেখা রঙিলা নটিবাড়িতে আনন্দে আছেজায়গাটা তার পছন্দ হয়েছেঅনেক উঁচু, প্রায় টিলার মতােবর্ষাকালে সােহাগগঞ্জ বাজারের অনেকটা ডুবে যায়রঙিলা বাড়ি শুধু ভেসে থাকেদূর থেকে দেখা যায় পানির উপর নকশা কাটা কাঠের একটা বাড়ি ভাসছেবাড়ির চারদিকে টিনের ছােট ছােট ঘরের চাল থেকে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করেসন্ধ্যাবেলা হারমােনিয়াম 

এবং সারেঙ্গির শব্দ ভেসে আসেবড়ই রহস্যময় লাগেবর্ষাকালে এই রহস্যময় জায়গায় লােকজনকে আসতে হয় নৌকায়বেশিরভাগ খদ্দের ভাটি অঞ্চলের পয়সাওয়ালা শৌখিনদার হাওরের মাছ বিক্রির কাঁচা টাকা নিয়ে এরা আসেকোমরে টাকার থলি বাধা থাকেএকটু নড়াচড়া করলেই ঝনঝন শব্দ হয়টি মেয়েদের কাচা রূপার টাকা নজরানা দেয়া দস্তুরময়লা কাগুজে নােটে শৌখিনদারি প্রকাশ পায় নারঙিলা বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা ভিড়ে তখন তারা চারদিকে তাকিয়ে বােকার মতাে হাসেতাদের বড়ই অস্থির মনে হয়পরিচিত কেউ দেখে ফেলল কিনা এই চিন্তাতেই তারা অস্থির । 

অতিরিক্ত পয়সাওয়ালা শরিফ আদমিদের মধ্যে অস্থিরতা থাকে নাতারা বজরা নিয়ে আসেবজরা থেকে নামে না তাদের সঙ্গে মাহফিল করতে রঙিলা বাড়ির মেয়েদের বজরায় যেতে হয়তবে তারা হিসেবিটাকাপয়সা খরচের ব্যাপারে সাবধানি হিসাব ছাড়া খরচ করে ভাটি অঞ্চলের বেকুবরাএরা সব টাকা শেষ করে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরে যায়তখনও তাদের মধ্যে হাসি থাকেসেই হাসি অন্যরকমযেন তারা একটা কাজের কাজ করেছে

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ

জুলেখা রঙিলা বাড়িতে ভর্তি হয়ে নতুন নাম নিয়েছে চান বিবি নতুন নাম নেয়াই দস্তুরঅতীত পেছনে ফেলে আসতে হবেযা গেছে তা গেছেঅতীত নিয়ে চিন্তার কিছু নেইএও এক ধরনের সংসারপ্রতিরাতে স্বামী বদলের সংসারএটাই মন্দ কী

চান বিবি একটা টিনের ঘর পেয়েছেঘরটা তার বড়ই পছন্দেরসামনেই বড়গাঙঘরের বারান্দায় বসে থাকলে বড়গাঙ ছাড়িয়ে দৃষ্টি অনেক দূরে চলে যায়তখন খুব উদাস লাগেঘরের সামনেই বিশাল এক কামরাঙা গাছএই গাছে সারা বছরই কামরাঙা হয়ভয়ঙ্কর টক, কাক দেশান্তরী জাতের কামরাঙা (কাক দেশান্তরী : যে টক ফল খেলে কাক দেশান্তরে পালিয়ে যায়)এই গাছটাও চান বিবির পছন্দগাছের নিচে বসলে চিড়ল চিড়ল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলাে এসে গায়ে পড়েএত ভালাে লাগেচান বিবি ঠিক করেছে, তার যদি কিছু টাকাপয়সা হয় তাহলে সে কামরাঙা গাছের তলাটা নিজ খরচে বাঁধিয়ে দেবেবাঁধানাে ঘাটে শীতলপাটি বিছানাে থাকবেশীতলপাটির উপরে পরিষ্কার ফুলতােলা বালিশ কখনাে সে বালিশে শুয়ে আকাশ দেখবেআবার কখনাে গাছে হেলান দিয়ে অতি দূরের গ্রামের সীমানা দেখবে। 

চান বিবির ফুট ফরমাস খাটার জন্যে তাকে সাতআট বছরের একটা মেয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার নাম হাছুনচান বিবি হাছুনকে নিজের মেয়ের মতাে যত্ন করে মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয়সপ্তাহে একদিন জলেভাসা সাবান

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ

দিয়ে তার গা ডলে দেয়হাছন চান বিবিকে মা ডাকেসারাদিনই সে ঘর পরিষ্কার করেসন্ধ্যাবেলা কার্তিকের মূর্তিতে প্রদীপ জ্বেলে দেয়ধূপদানে ধূপ জ্বালে রঙিলা বাড়ির প্রতিটি ঘরেই কার্তিকের মূর্তি আছেকার্তিক পতিতাদের দেবতাপতিতা হিন্দু হােক মুসলমান হােক, তার ঘরে কার্তিকের মূর্তি থাকবেই। 

রঙিলা বাড়ির মালেকাইন হিন্দুস্থানিনাম সরজুবালাএই হিন্দুস্থানি মালেকাইনকেও চান বিবির পছন্দবয়স পঞ্চাশের উপরেগায়ের রঙ পাকা ডালিমের মতােসন্ধ্যাবেলা তিনি যখন চোখে কাজল দিয়ে সারেঙ্গি নিয়ে বসেন তখন তাকে দেখলে চান বিবির অদ্ভুত লাগেতার কাছে মনে হয় এই মহিলা পৃথিবীর কেউ নাঅন্য কোনাে জগতেরতার গানের গলাও চমৎকারমীরার ভজন গাওয়ার সময় সরজুবালার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়েএই দৃশ্য দেখেও চান বিবি মুগ্ধ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *