আকাশে মেঘ । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘােমটা পরা তরুণী দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর নাম জুলেখা। একসময় সে অস্ফুট স্বরে বলল, কী সৌন্দর্য গাে! কী সৌন্দর্য! ঠিক একই সময় জুলেখার বয়সি একটা মেয়েও জাহাজে করে আটলান্টিক পার হচ্ছিল। সে একা একা জাহাজের ডেকে বসেছিল। সেও মহাসাগরের শােভা দেখে জুলেখার মতােই মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল— কী সুন্দর! কী সুন্দর!
মেয়েটি নােবেল পুরস্কার বিজয়ী মাদাম কুরি। তিনি রেডিও অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ট্রাস্টের আমন্ত্রণে বেড়াতে যাচ্ছেন আমেরিকায়। | আমাদের জুলেখার সেই বৎসর স্থান হলাে কেন্দুয়ার বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতে। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘রঙিলা নটিবাড়ি‘।
Encyclopedia Britanica‘র প্রাচীন সংস্করণে কেন্দুয়ার উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা ছিল Kendua a place for dancing girls. আনন্দদায়িনী নর্তকীদের মিলনমেলা।
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
রঙিলা নটিবাড়ি সােহাগগঞ্জ বাজারের শেষ মাথায়। মাছের আড়ত পার হয়েও আট–দশ মিনিট হাঁটতে হয়। রাস্তার দু‘পাশে আপনাতে গজিয়ে ওঠা বেশকিছু শিমুলগাছ। যে–কেউ দেখে ভাববে কোনাে এক বৃক্ষপ্রেমী চিন্তাভাবনা করে শিমুলের সারি লাগিয়েছেন। চৈত্রমাসে শিমুলের টকটকে লাল ফুল ফোটে । দেখতে ভালাে লাগে। মনে হয় চৈত্রের তীব্র উত্তাপে গাছের মাথায় আগুন লেগে গেছে।
মূল বাড়ি কাঠের । উপরে টিন। মূল বাড়ি ঘিরে এক রুমের বেশ কিছু ছােট ছােট ঘর। কাঠের মূল বাড়িটা দর্শনীয় । উচ্চতায় প্রায় দোতলা বাড়ির সমান। দরজা এবং পাল্লায় ফুল লতাপাতা আঁকা। টিনের চৌচালাতেও নকশা কাটা। লখনৌ-এর বাইজি আংগুরি অনেক টাকা–পয়সা খরচ করে মূল বাড়ি তৈরি করে। এই বাড়িতে তার একটা কন্যাসন্তান হয়। তার নাম বেদানা। তিন বছর বয়সে বেদানা পানিতে ডুবে মারা যায়। বেদানার মৃত্যুর পর আংগুরির আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায় নি। কেউ বলে আংগুরিও মেয়ের মতাে পানিতে ডুবে গেছে। আবার কারাে কারাে মতে আংগুরি দেশান্তরী হয়েছে।
‘দেশান্তরী‘ শব্দটা এলাকার মানুষের অতি প্রিয়। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই স্বামীরা বলে, দেশান্তরী হবাে, আসাম চলে যাব। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে যাবার বাসনার কারণ— আসাম খুব দূরের দেশ না। বন–জঙ্গল পাহাড়–পর্বতের অঞ্চল। সেখানেই আছে কামরূপ কামাক্ষ্যা। জাদুবিদ্যার দেশ। কামরূপ কামাক্ষ্যার অতি রূপবতী নারীরা পুরুষদের বশ করে চিরদিনের জন্যে রেখে দিতে পছন্দ করে। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে গেলে ফেরা হয় না সেই কারণেই।
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
জুলেখা রঙিলা নটিবাড়িতে আনন্দে আছে। জায়গাটা তার পছন্দ হয়েছে। অনেক উঁচু, প্রায় টিলার মতাে। বর্ষাকালে সােহাগগঞ্জ বাজারের অনেকটা ডুবে যায়। রঙিলা বাড়ি শুধু ভেসে থাকে। দূর থেকে দেখা যায় পানির উপর নকশা কাটা কাঠের একটা বাড়ি ভাসছে। বাড়ির চারদিকে টিনের ছােট ছােট ঘরের চাল থেকে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করে। সন্ধ্যাবেলা হারমােনিয়াম
এবং সারেঙ্গির শব্দ ভেসে আসে। বড়ই রহস্যময় লাগে। বর্ষাকালে এই রহস্যময় জায়গায় লােকজনকে আসতে হয় নৌকায়। বেশিরভাগ খদ্দের ভাটি অঞ্চলের পয়সাওয়ালা শৌখিনদার । হাওরের মাছ বিক্রির কাঁচা টাকা নিয়ে এরা আসে। কোমরে টাকার থলি বাধা থাকে। একটু নড়াচড়া করলেই ঝনঝন শব্দ হয়। নটি মেয়েদের কাচা রূপার টাকা নজরানা দেয়া দস্তুর। ময়লা কাগুজে নােটে শৌখিনদারি প্রকাশ পায় না। রঙিলা বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা ভিড়ে তখন তারা চারদিকে তাকিয়ে বােকার মতাে হাসে। তাদের বড়ই অস্থির মনে হয়। পরিচিত কেউ দেখে ফেলল কি–না এই চিন্তাতেই তারা অস্থির ।।
অতিরিক্ত পয়সাওয়ালা শরিফ আদমিদের মধ্যে অস্থিরতা থাকে না। তারা বজরা নিয়ে আসে। বজরা থেকে নামে না । তাদের সঙ্গে মাহফিল করতে রঙিলা বাড়ির মেয়েদের বজরায় যেতে হয়। তবে তারা হিসেবি। টাকা–পয়সা খরচের ব্যাপারে সাবধানি । হিসাব ছাড়া খরচ করে ভাটি অঞ্চলের বেকুবরা। এরা সব টাকা শেষ করে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরে যায়। তখনও তাদের মধ্যে হাসি থাকে। সেই হাসি অন্যরকম। যেন তারা একটা কাজের কাজ করেছে।
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
জুলেখা রঙিলা বাড়িতে ভর্তি হয়ে নতুন নাম নিয়েছে চান বিবি । নতুন নাম নেয়াই দস্তুর। অতীত পেছনে ফেলে আসতে হবে। যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এও এক ধরনের সংসার। প্রতিরাতে স্বামী বদলের সংসার। এটাই মন্দ কী ?
চান বিবি একটা টিনের ঘর পেয়েছে। ঘরটা তার বড়ই পছন্দের। সামনেই বড়গাঙ। ঘরের বারান্দায় বসে থাকলে বড়গাঙ ছাড়িয়ে দৃষ্টি অনেক দূরে চলে যায়। তখন খুব উদাস লাগে। ঘরের সামনেই বিশাল এক কামরাঙা গাছ। এই গাছে সারা বছরই কামরাঙা হয়। ভয়ঙ্কর টক, কাক দেশান্তরী জাতের কামরাঙা (কাক দেশান্তরী : যে টক ফল খেলে কাক দেশান্তরে পালিয়ে যায়)। এই গাছটাও চান বিবির পছন্দ। গাছের নিচে বসলে চিড়ল চিড়ল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলাে এসে গায়ে পড়ে। এত ভালাে লাগে। চান বিবি ঠিক করেছে, তার যদি কিছু টাকা–পয়সা হয় তাহলে সে কামরাঙা গাছের তলাটা নিজ খরচে বাঁধিয়ে দেবে। বাঁধানাে ঘাটে শীতলপাটি বিছানাে থাকবে। শীতলপাটির উপরে পরিষ্কার ফুলতােলা বালিশ । কখনাে সে বালিশে শুয়ে আকাশ দেখবে। আবার কখনাে গাছে হেলান দিয়ে অতি দূরের গ্রামের সীমানা দেখবে।
চান বিবির ফুট ফরমাস খাটার জন্যে তাকে সাত–আট বছরের একটা মেয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার নাম হাছুন। চান বিবি হাছুনকে নিজের মেয়ের মতাে যত্ন করে । মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয়। সপ্তাহে একদিন জলেভাসা সাবান
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
দিয়ে তার গা ডলে দেয়। হাছন চান বিবিকে মা ডাকে। সারাদিনই সে ঘর পরিষ্কার করে। সন্ধ্যাবেলা কার্তিকের মূর্তিতে প্রদীপ জ্বেলে দেয়। ধূপদানে ধূপ জ্বালে । রঙিলা বাড়ির প্রতিটি ঘরেই কার্তিকের মূর্তি আছে। কার্তিক পতিতাদের দেবতা। পতিতা হিন্দু হােক মুসলমান হােক, তার ঘরে কার্তিকের মূর্তি থাকবেই।
রঙিলা বাড়ির মালেকাইন হিন্দুস্থানি। নাম সরজুবালা। এই হিন্দুস্থানি মালেকাইনকেও চান বিবির পছন্দ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। গায়ের রঙ পাকা ডালিমের মতাে। সন্ধ্যাবেলা তিনি যখন চোখে কাজল দিয়ে সারেঙ্গি নিয়ে বসেন তখন তাকে দেখলে চান বিবির অদ্ভুত লাগে। তার কাছে মনে হয় এই মহিলা পৃথিবীর কেউ না। অন্য কোনাে জগতের। তার গানের গলাও চমৎকার। মীরার ভজন গাওয়ার সময় সরজুবালার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। এই দৃশ্য দেখেও চান বিবি মুগ্ধ।