রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৫)

বন্ধুর রােগমুক্তি উপলক্ষে ছােটখাট উৎসবের আয়ােজন করা হয়েছিল । আজরাইলের হাত থেকে বাইম মাছের মত পিছলে বের হয়ে আসা কোনাে সহজ ব্যাপার না।

রূপার পালঙ্ক যে মানুষ এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্যে বড় উৎসবই করা দরকার। বড় উৎসবের সামর্থ্য কোথায় ? ভদকার একটা বােতল যে জোগাড় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। এক বােতল ভদকা, খাসির চাপ, হাজির বিরিয়ানি। আসর বসেছে বজলুর ঘরে। মােবারক এবং বজলু অতি দ্রুত বােতল শেষ করছে। জহির শুকনাে চোখে তাকিয়ে আছে। তার শুকনাে চোখ দেখে মায়া লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আগে প্রাণে বাঁচতে হবে। জহিরের 

গন্ধ শোঁকা নিষিদ্ধ বলেই তারা ভদকা এনেছে। ভদকার গন্ধ নেই। 

মােবারক বলল, নিয়ম রক্ষার জন্য এক ফোটা খাবি নাকি রে জহির। জাস্ট ওয়ান ড্রপ। জিভ বের কর। জিভের আগায় এক ফোটা দিয়ে দেই। 

জহির না-সূচক মাথা নাড়ল। মােবারক বলল, থাক কোনাে দরকার নেই। তুই শুয়ে থাক। বিরিয়ানি গরম আছে। গরম গরম খেয়ে শুয়ে পড়। আমি মাথা বানিয়ে দেব। 

বজলু বলল, ডাক্তার যে মৃত্যুর ভয় দেখাল, কাজটা কি ঠিক করল ? মৃত্যুর কথা বলার তুমি কে? মৃত্যুর মালিক হলেন আল্লাহ্। তিনি ইচ্ছা করলে মৃত্যু হবে। ইচ্ছা না করলে দশ বােতল ভদকা খেলেও কিছু হবে না। জহিরের কি বাঁচার আশা ছিল ? ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল না।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

তারপরেও বাঁচল কীভাবে? আরে বাবা তুমি ডাক্তার হয়েছ বলে যা ইচ্ছা তাই বলবে? তােমার মত ডাক্তার আমি …’ দিয়েও পুছি না। রােগ যদি হয়, অষুধ দিয়ে রােগ সারাবে। বড় বড় কথা কী জন্যে? আমি বজলুর রহমান তােমার কথার উপরে পেচ্ছাব করি।। 

মােবারক বলল, আমি পেচ্ছাব করে দেই। 

আধা বােতল ভদকা শেষ হবার পরেও দেখা গেল নেশা যে ভাবে হওয়া উচিত সেভাবে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া নেশা হচ্ছে। এই ভাব আসছে, এই চলে যাচ্ছে। নেশার ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। কোনাে কোনাে দিন কিছু খেতে হয় ,

বােতল দেখেই নেশা হয়ে যায়। আবার কোনাে কোনাে দিন যতই খাও কিছু হবে না। মাথা ঝিম ঝিম করবে, বমি ভাব হবে কিন্তু আসল যে জিনিস— 

ভাব’ সেটা আসবে না। 

বজলু বিরক্ত মুখে বলল, নেশা হচ্ছে না। ব্যাপারটা কী ? মােবারক তাের অবস্থা কী ? 

মােবারক বিরস মুখে বলল, মনে হয় পানি খাচ্ছি। মিনারেল ওয়াটার। 

এতদিন পর হাসপাতাল থেকে বন্ধু রিলিজ পেয়েছে। সেই আনন্দে যদি একটু নেশাও না হয় তাহলে বন্ধুর ফিরে আসার দরকার কী ছিল ? বজলু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজকর্ম সব সময় তিনজন একত্রে করেছি। আজ দুইজন, একজন থেকেও নেই। এই জন্যেই কিছু হচ্ছে না। বােতল শেষ করে লাভ নেই, বাদ দে।

জহির তখন ক্ষীণ গলায় বলল, বেশি করে পানি মিশিয়ে সামান্য একটু দে। তিন চার ফোটার বেশি না। নিয়ম রক্ষার জন্যে খাওয়া। 

দরকার নেই। বাদ দে। এতবড় অসুখ থেকে উঠলি। খাই এক ফোঁটা। এক ফোঁটায় আর কী হবে? 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

জহিরকে সামান্য দেয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুর নেশা ঝাকিয়ে এল। বজলু বল, বােতলতাে শেষ হয়ে আসছে। তিন বােতল ফেন্সি’ নিয়ে আসি। ভদকার পরে ফেলি—উড়াল দেয়া নেশা হবে। ফেন্সি জহিরও খেতে পারবে। ডাক্তার মদ খেতে নিষেধ করেছে ফেলি খেতে নিষেধ করেনি। তাছাড়া ফেলি অষুধের মত কফ সিরাপ। কীরে জহির ফেন্সি খাবি একটা। 

জহির বলল, না। 

আমােদ ফুর্তিই যদি না করলি বেঁচে থেকে লাভটা কী? সকালে চিড়া ভিজানাে পানি এক গ্লাস চিরতার রস, বিকালে জাউ ভাত। রাতে এক পিস আটার রুটি। সিগারেট না, মদ না, গাজা না। এই ভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী নায়লনের একটা দড়ি কিনে নিয়ে আসি, ঝুলে পড়। 

মােবারক উদাস গলায় বলল, এটা মন্দ না। দুই বােতল ফেন্সি আন আর তিন গজ নায়লনের দড়ি। বু কালার। 

বু কালার কেন ? বজলু গম্ভীর গলায় বলল, মৃত্যুর রঙ নীল। এই জন্যে। 

এত কিছুর পরেও জহির এক ফোঁটা মুখে দিল না। দুই বন্ধুরই খুব মেজাজ খারাপ হল। সাতশ টাকার বােতলে সাত টাকার নেশা হল না। ধরে যাওয়া নেশা একবার চটে গেলে কিছুতেই কিছু হয় না। ঝিম ভাব হয়- ঝিম ভাব আর নেশা এক না। পর পর তিন রাত অঘুমাে থাকলেও ঝিম ভাব হয়। 

মােবারক নড়ে চড়ে বসল। চায়ের স্টলের বাইরে জহির এসে দাড়িয়েছে। ইদুরের মত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে খুঁজছে বলাই বাহুল্য। গাধার গাধা– সে জানে না মােবারক কোথায় বসে? তুই পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক দেখে ফেললি- আসল দিক দেখলি না ? তাের কি ব্রেইনে সমস্যা হয়েছে।

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

নাকি সন্ধ্যাবেলাতেই কিছু খেয়ে এসেছিস ? দাড়ি শেভ নাই। চুল উবুন্ধু। একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে যার পাঁচটা বােতামের মধ্যে দু’টা নাই। শার্টের ফাক দিয়ে বুকের লােম বের হয়ে আছে। তুই ভেবেছিস কী ? তাের বুকের লােম দেখে মেয়েরা মূৰ্ছা যাবে ? কাঁধে আবার বাহারি ব্যাগ। ব্যাগের পেট ফুলে আছে। কে জানে কী আছে ব্যাগে। 

জহির মােবারককে দেখেছে। জহিরের মুখ ভর্তি হাসি। যেন দশ বছর পরে পুরনাে বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল। মােবারকের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, তাের হাসি মুখে আমি পেচ্ছাব করে দেই। আরে শুওরের বাচ্চা গত দুই দিন তুই ছিলি কোথায় ? এমন তাে না যে বিয়ে করেছিস শাশুড়িকে সালাম করতে যেতে হবে। শালীর গালে ধরে রং ঢং করতে হবে। 

জহির এসে মােবারকের সামনে বসল। বসেই মােবারকের মারলবােনরা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সিগারেট বের করল। যেন তার শ্বশুরের টাকায় কেনা সিগারেট। শ্বশুর চায়ের স্টলের টেবিলে ফেলে রেখে গিয়েছিল।এখন জামাইকে পাঠিয়েছে খুঁজে নিয়ে যাবার জন্যে। বন্ধুর সিগারেট খাচ্ছে আচ্ছা ঠিক আছে খাক। এত দামি বিদেশী সিগারেট, একবার জিজ্ঞেস করবে 

সিগারেটের এই প্যাকেট কোথেকে পাওয়া গেল। নাকে মুখে কেমন ধুয়া ছাড়ছে, যেন তার শ্বশুর বাড়ির সস্তা ধুয়া। 

জহির বলল, আছিস কেমন ? | মােবারক জবাব দিল না। তার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। সবচে’ ভাল হত যদি উঠে চলে যেতে পারত। উঠে চলে যাওয়া এক সপ্তাহের জন্যে ডুব মারা। তােরা দুই দিনের জন্যে ডুব দিতে পারলে আমিও এক সপ্তাহের জন্যে ডুব দিতে পারি। 

জহির বলল, তাের গায়ে উলের চাদর ? মােবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলতে উলের চাদর না । পাটের কোস্টার চাদর। চাদরও না, গামছা। 

জহির বলল, চাদর পেয়েছিস কোথায় ?

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারক গম্ভীর গলায় বলল, আমার নিজের চাদর। এর মধ্যে পাওয়া পাওয়ি কী ? 

জিনিস ভাল। 

মােবারক বলল, জিনিস যে ভাল তােকে সেই সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার জিনিস আমি জানি ভাল না মন্দ। 

রেগে আছিস কেন? 

মােবারক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে ঢুকিয়ে ফেলল । জহিরের স্বভাব খারাপ। সামনে সিগারেটের প্যাকেট থাকলে ক্রমাগত খেয়ে যাবে। দুই মাসও হয়নি এতবড় অসুখ থেকে 

উঠেছে কিছু সাবধান হওয়াতাে দরকার। মদের চেয়েও ক্ষতি করে সিগারেট। 

জহির বলল, গরমের মধ্যে চাদর গায়ে ঘুরছিস কেন? ইচ্ছা হয়েছে ঘুরছি। তাতে তাের কোনাে সমস্যা হয়েছে ? গরমের মধ্যে উলের চাদর। তােকে দেখে আমার নিজেরই গরম লাগছে। গরম লাগলে শার্ট প্যান্ট খুলে ন্যাংটা হয়ে যা। জহির গলা নামিয়ে বলল, চাদরের নিচে কিছু আছে? 

থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। সাতটা বােতল। এক নম্বরী ডাইল’। সিগারেটের প্যাকেট সামলে ফেললি কেন? দেখি প্যাকেট বের কর । 

মােবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করল। জহিরের উপর তার রাগটা অতি দ্রুত কমছে। এই তার এক সমস্যা। সে রাগ ধরে রাখতে পারে না। অতি দ্রুত কমতে থাকে। শুধু যে রাগ কমছে তা না। এখন আবার মায়াও লাগতে শুরু করেছে। কী অবস্থা করেছে শরীরের। এত বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে-নিজের শরীরের দিকে তাকাবে না ? মনে হচ্ছে দুপুরে সে কিছু খায়ওনি। কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছিল। পায়ে কী কিছু হয়েছে

মােবারক বলল, দুপুরে ভাত খেয়েছিস? 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

কেন? সময় পাই নাই। 

সময় পাস নাই কেন? তুই কি মিনিস্টার যে মিটিং মিছিল করে দম ফেলতে পারছিস না। 

মােবারক চোখের ইশারায় বটুকে ডেকে দু’টা পরােটা আর শিক কাবাব দিতে বলল। 

জহির হামলে পড়ে খাচ্ছে। দেখে মায়া লাগছে। এই দুই দিন ছিলি কোথায় ? নারায়ণগঞ্জ। সেখানে কী ? 

ছােট খালু মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়ে বিরাট ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেলাম। 

পাড়ার লােকের কী দায় পড়েছে । 

মােবারক বলল, তাের পায়ে কী হয়েছে ? জহির বলল, রগে টান পড়েছে মনে হয়। ল্যাংড়া হয়ে যাবি তাে। 

কী ক্যাচাল ? 

আরে টাকা নাই, পয়সা নাই। দশ গজ কাফনের কাপড় কিনতে গিয়েছে তাও টাকা শর্ট পড়েছে। খালা আমাকে ধরে ভ্যা ভ্যা করা শুরু করল– ওরে কই যাব রে? তুই বলে যা কই যাব রে? 

আমার নিজের যাওয়ার নাই ঠিক, আমি কী করে বলব- কই যাবে ? দাফন করতে যাবে, আমি বললাম, খালা আমাকে পাচটা মিনিট সময় দেন। চা খাবার নাম করে আসছি। চা খেতে বের হয়ে ফুটলাম । 

ভাল করেছিস। 

ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা। এর মধ্যে একটার আবার উঠেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢলি হচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা। 

মােবারক বলল, তুই গেলি কেন খামাখা। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। 

(চলবে)

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৪)

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *