লিলিয়ান চুপ করে রইল। তাহেরের মনে হল এই মেয়ে আর কোন প্রশ্নের জবাব দেবে না। মেয়েটিকে সহজ করার কোন পথও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কি বললে সে সহজ হবে ? ‘লিলিয়ান তুমি কি পেট্রিফায়েড ফরেস্টটা দেখতে চাও? ঐদিন আমি যাই নি।
তুমি যেতে চাইলে আজ যেতে পারি। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসতে পারব।
‘আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাব।
বেশ তাে ফিরে যাবে। আমি তােমাকে পৌছে দেব। ‘আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে না।
‘তুমি লক্ষ্য কর নি বােধহয় বাইরে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। এই ঠাণ্ডায় তুমি এমন পাতলা কাপড় পরে কি করে এসেছ সেও এক রহস্য। তুমি আমার সঙ্গে যেতে না চাইলে একাই যাবে – আমার একটা ওভারকোট আছে সেটা গায়ে চাপিয়ে চলে যেতে পারবে। না–কি আমার ওভারকোটও গায়ে দেবে না? | লিলিয়ান বসল। সে যে বসেছে তাতে সে নিজেও অবাক হয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পুরাে ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। সে নিজের ইচ্ছেতে কিছু করছে না। যা তাকে করতে বলা হচ্ছে তাই সে করছে। পুরাে ঘটনা অন্য কেউ ঘটাচ্ছে। সে অন্য কেউটা কে ?
‘লিলিয়ান। ‘হুঁ। ‘কফি খাবে?”
‘শুনে খুশি হলাম। আমি কফি তৈরি করছি। তুমি সহজ এবং স্বাভাবিক হতে চেষ্টা কর। তারপর তােমার কাছে কয়েকটা জিনিস জেনে নেব। যা যা জানতে চাই তাও বলে নিচ্ছি, – এক, হঠাৎ তুমি একগাদা ফুল নিয়ে আমার কাছে কেন এসেছ? দুই, আজ যে আমার জন্মদিন তা–কি তুমি জান? যদি জান তাহলে কিভাবে জান?
আয়নাঘর-পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
লিলিয়ান বিস্মিত হয়ে বলল, আজ আপনার জন্মদিন?
তাহের বলল, আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব পেয়ে গেছি। আজ যে আমার জন্মদিন তা তুমি জান না। এখন বাকি রইল প্রথম প্রশ্ন। তুমি প্রশ্নটির জবাব নিয়ে ভাবতে থাক। আমি একটু গ্রোসারি শপে যাব। ঘরে কফি, চিনি, ক্রীম কিছুই নেই।
‘আমি কি আপনার এখান থেকে একটা টেলিফোন করতে পারি ? ‘হ্যা পার। ‘একটা লং ডিসটেন্স কল করব। | ‘একটা কেন দশটা কর। তুমি আমার এখানে আসায় আমি নিজে যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছি তা কোনদিন তুমি বুঝবে না। প্রথম দেখাতেই ভালবাসা’ – এই জাতীয় কিছু কথা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই জাতীয় বায়বীয় কথা আমি কখনাে বিশ্বাস করতাম না। তােমাকে ওল্ড ফেইথফুল লেকের কাছে দেখে প্রথম মনে হল – সাহিত্যের এই কথাটা মিথ্যা না। মেয়েদের পেছনে ঘােরা আমার স্বভাব নয়।
আয়নাঘর-পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
তারপরেও আমি খুঁজে খুঁজে তােমার অ্যাপার্টমেন্ট বের করেছি। ঐদিন তােমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে দেখা হল। তােমার বােধহয় ধারণা পুরাে ব্যাপারটা কাকতালীয়। আসলে তা না। আমি প্রায়ই তােমাদের মেমােরিয়াল ইউনিয়নে বসে থাকতাম এই আশায় যে তােমার সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হলেই বলব, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম ... কবে কোথায় কোন্ রুমে তােমার ক্লাস তাও আমি জানি – প্রমাণ
লিলিয়ান তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। তাহের আগের মতই সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আজ ছিল তােমার টার্ম পেপার জমা দেয়ার শেষ দিন।
আমি কি ঠিক বলেছি ? লিলিয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল। তাহের বলল, আমি কফি নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমার আসতে খানিকটা দেরি হবে। আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটা ভাল
হােটেলে আমি তােমাকে নিয়ে খেতে যাব। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোন কারণ নেই। খাওয়ার শেষে আমি তােমাকে তােমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌছে দেব। তুমি যে এসেছ এতেই আমি খুশি। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি। যা হয়েছে তাই যথেষ্ট। যদিও জানি না – ঘটনা এমন কেন ঘটল। ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তােমার ইচ্ছা করলে তুমি ব্যাখ্যা করবে। ইচ্ছা না করলে করতে হবে না।
আয়নাঘর-পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
তাহের ঘর ছেড়ে চলে গেল। লিলিয়ান উঠে দরজা বন্ধ করল। টেলিফোন করল তার মা’কে। লিলিয়ানের মা আতঙ্ক মেশানাে গলায় বললেন, আমি এর মধ্যে তিনবার তাের অ্যাপার্টমেন্টে টেলিফোন করেছি। আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।
‘চিন্তার কিছু নেই মা। ‘তুই কি গিয়েছিলি কোন ডাক্তারের কাছে?”
‘ডাক্তার কি বললেন ? ‘ডাক্তার নতুন কিছু বলে নি। আমি যা জানতাম তাই বলেছেন। ‘আমি তাের কথা কিছু বুঝতে পারছি না। তুই কি জানতি ? লিলিয়ান হাসল। শব্দ করে হাসল। লিলিয়ানের মা বললেন, কি হল হাসছিস
‘হাসি আসছে তাই হাসছি ? ‘তুই এখন কোথায় ? “কেন আমার অ্যাপার্টমেন্টে। ‘না, তুই অন্য কোন জায়গায়। “কি করে বুঝলে ?” ‘আমি জানি। আমার মন বলছে। তুই কি ঐ ছেলেটির কাছে? ‘হ্যা। ‘কেন – ঐখানে কেন? কি হচ্ছে লিলিয়ান ?” ‘ভয়ের কিছু নেই মা। ‘অবশ্যই ভয়ের কিছু। তুই কেন ঐ ছেলের কাছে গেলি?”
লিলিয়ান খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা বারবার বলতে লাগলেন – হ্যালাে হ্যালো।
‘মা শােন, আমি খুব সম্ভব এই ভদ্রলােককে বিয়ে করব। ‘কি বলছিস তুই ?”।
‘আমি এখনাে জানি না। ভদ্রলােক এখানে নেই। তিনি কফি কিনতে গিয়েছেন। ফিরে এলেই তাঁকে বলব।
‘কি বলবি?”
‘বলব যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। যদি রাজি থাকেন তবেই শুধু আপনার সঙ্গে কফি খাব, এবং রাতে ডিনার করতে যাব।
আয়নাঘর-পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
‘হা ঈশ্বর ! মা তুই কি বলছিস? তাের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা। আমি নিশ্চিত তাের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
‘অস্থির হয়াে না মা। আমার মাথা খারাপ হয় নি। মাথা ঠিক আছে। আর এক্ষুণি তােমাদের চিন্তিত হতে হবে না। হয়ত বিয়েতে ভদ্রলােক রাজি হবেন না। হয়ত বলবেন – তিনি বিবাহিত।
‘লােকটা বিবাহিত কিনা তাও তুই জানিস না?” ‘না।” ‘হা ঈশ্বর ! এসব কি শুনছি! ‘কথায় কথায় হা ঈশ্বর বলবে না মা। শুনতে ভাল লাগছে না।‘ ‘লিলিয়ান লক্ষ্মী মা তুই দেশে চলে আয়। তােকে পড়াশােনা করতে হবে না। ‘কাঁদছ কেন মা! আমি তাে ভয়ংকর কিছু করছি না। “তুই তাের পজার চাচার সঙ্গে কথা বল। ‘আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব না। ‘তাের বাবার সঙ্গে কথা বল। ‘বললাম তাে মা, আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব না। ‘হা ঈশ্বর ! আমি এ কি শুনছি ?
লিলিয়ান শান্ত স্বরে বলল, ঈশ্বরের প্রতি তােমার অবিচল ভক্তি। কাজেই তুমি। ধরে নাও – যা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার আগােচরে হচ্ছে না।
“লিলিয়ান মা লিলিয়ান ... ‘টেলিফোন রাখছি মা। তুমি ভাল থেকো।
Read more