লিলিয়ানের মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। লিলিয়ান জানালার পাশে দাঁড়াল। বরফ পড়তে শুরু করেছে – বছরের প্রথম বরফ। ইচ্ছে করছে বরফের ভেতর ছুটে যেতে। সারা গায়ে বরফ মাখতে। লিলিয়ান খানিকক্ষণ বরফ পড়া দেখল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্যেই বােধহয় তার চোখ জ্বালা করছে।
সে বাথরুমে ঢুকে চোখে পানি দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। ফিসফিস করে বলল, মা রাগ। করাে না। আমি কি করছি আমি নিজেও জানি না। এর ফল শুভ হবে, কি শুভ হবে না তাও জানি না। শুধু একটা জিনিস জানি – আমৃত্যু আমাকে অচেনা-অজানা এই ছেলেটির সঙ্গে থাকতে হবে। এর থেকে আমার মুক্তি নেই। কিংবা কে জানে আমার মুক্তি হয়ত বন্ধনের ভেতরই ঘটবে।
দরজায় কলিং বেল বাজছে। লিলিয়ান দরজা খুলে দিল। তাহের মুগ্ধ গলায় বলল, বাইরে বরফ পড়ছে দেখেছ?
‘হা। ‘গায়ে বরফ মাখবে?” ‘হ্যা মাখব।
‘বাহ চমৎকার ! আমাদের দেশে বরফ নেই, তবে বৃষ্টি আছে। বৎসরের প্রথম বৃষ্টি হলে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি, এতে গায়ের ঘামাচি নষ্ট হয়। বরফে কিছু নষ্ট হয় কি না কে জানে।
“তােমাদের দেশের বৃষ্টি কি তুষারপাতের চেয়েও সুন্দর ?”
আয়নাঘর-পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
‘লক্ষ গুণ সুন্দর। আমাদের দেশের প্রথম বৃষ্টিতে কি হয় জান – এক ধরনের মাছ আছে – নাম হল কৈ মাছ। এরা এত আনন্দিত হয় যে দলবেঁধে পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।
“কেন আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ ?”
‘মােটেই ঠাট্টা করছি না। তােমাকে আমি দেশে নিয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখাব। তখন তুমি ...‘
তাহের কথা শেষ করল না, থেমে গেল। বিব্রত চোখে লিলিয়ানের দিকে তাকাল। লিলিয়ানও তাকিয়ে আছে। লিলিয়ানের চোখে চাপা দ্যুতি।
ওদের বিয়ে হতে দশ দিন লাগল। বিয়ের লাইসেন্স বের করা এদেশে অনেক যন্ত্রণা। অনেক টেস্ট–ফেস্ট করতে হয়। ডাক্তাররা আগে নিশ্চিত হয়ে নেন এই দম্পতির সন্তান বংশগত কোন রােগের স্বীকার হবে না। তারপরই সার্টিফিকেট দেন। সেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে লাইসেন্সের জন্যে দরখাস্ত করতে হয়। | বিয়ের পরপর লিলিয়ান ডাঃ আরমানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ডঃ ভারমান চশমার ফাঁক দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, মিস থেকে মিসেস হয়েছে ?
কি করে বুঝলেন? আমার কপালে তাে লেখা নেই মিসেস।
‘অবশ্যই লেখা আছে। সেই লেখা সবাই পড়তে পারে না। আমি পারি। তুমি কি ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করেছ ?”
‘দুঃস্বপ্ন এখন নিশ্চয়ই দেখছ না। ‘জ্বি–না দেখছি না। ‘শুনে খুব খুশি হলাম। মনস্তত্ত্ববিদ্যা একটি বড় বিদ্যা তা কি বুঝতে পারছ?” ‘পারছি।
আয়নাঘর-পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
‘ভবিষ্যতে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে আমার কাছে আসবে। তবে আমার মনে হয় ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হবে না। যদি হয় তুমি নিজে তার সমাধান করতে পারবে। পারবে না?”
‘হ্যা পারব।
“তােমার হাসি–খুশি মুখ দেখে ভাল লাগছে। সত্যিকার হাসিমুখ অনেক দিন দেখি না। চারদিকে ভেজাল হাসি দেখি।।
‘হাসির ভেজালও আপনি ধরতে পারেন?
‘অবশ্যই পারি। আমার নিজের মুখে যে হাসিটি আমি ঝুলিয়ে রাখি তা হল। ভেজাল হাসি। একশ’ ভাগ ভেজাল! তুমি তােমার জীবনে ভেজাল হাসিকে আসতে , দিও না। মনে কষ্ট পেলে কাঁদবে। মনের কষ্ট চাপা দেয়ার জন্যে হাসির ভান করার প্রয়ােজন নেই।
‘আমি আপনার উপদেশ মনে রাখব ডঃ ভারমান।
ডঃ ভারমানের উপদেশের জন্যেই হয়ত দেশ থেকে মার চিঠি পেয়ে লিলিয়ান সারাদিন কাঁদল। চিঠিটি তিনি মেয়ের বিয়ের সংবাদ পাওয়ার পর লিখেছিলেন। সংক্ষিপ্ত চিঠি। যদিও লিলিয়ানের মার হাতে লেখা তবু লিলিয়ান জানে – এই চিঠি তার বাবা লিখে দিয়েছেন। মা শুধু দেখে দেখে কপি করেছেন। কপি করতে গিয়েও মার বানান ভুল হয়েছে। বাবা সেই সব বানান শুদ্ধ করেছেন।
আয়নাঘর-পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
লিলিয়ান,
তােমার বিবাহের সংবাদ পাইয়াছি। আনন্দে উল্লসিত হই নাই। তুমি নিশ্চয়ই তা আশাও কর না। তুমি খুব ভাল জান তুমি আমাদের সবার অতি আদরের ধন ছিলে। তােমাকে নিয়া আমাদের স্বপ্নের অন্ত ছিল না। তুমি সব স্বপ্নের অবসান ঘটাইয়াছ। আমি তােমাকে দোষ দেই না। ঈশ্বরের হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। এই ক্ষেত্রেও তাঁর ইচ্ছারই প্রতিফলন হইয়াছে। আমি তােমার এবং তােমার স্বামীর সুখী সুন্দর জীবন কামনা করি। যে সুখের জন্যে তুমি আমাদের পরিবারের সকলের সুখ তুচ্ছ করিয়াছ, ঈশ্বর যেন সেই সুখ তােমাকে দেন ইহাই আমাদের সকলের কামনা।
এখন তােমাকে কিছু কথা বলিব মন দিয়া শােন। তােমার বাবা পরিবারের সদস্য হিসাবে তােমাকে গ্রহণ করিবার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। আমাদের সকলেরই সেইমত অভিমত। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে তােমাকে বর্জন করা হইয়াছে। ইহাতে মনে কষ্ট পাইও না। তুমি সকলকে ত্যাগ করিয়া একজনকে পাইতে চাহিয়াছ। ঈশ্বর তােমার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়াছেন।
এক্ষণে বাড়িতে তােমার নাম আর উচ্চারিত হইবে না। তােমার ব্যবহারী জিনিস, তােমার ফটোগ্রাফ সমস্তই নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তুমি আমাদের সহিত কোন রকম যােগাযােগ রাখিবার চেষ্টা করিবে না। যােগাযােগ করিবার চেষ্টার অর্থই হইবে আমাদিগকে কষ্ট দেওয়া এবং নিজে কষ্ট পাওয়া।
আয়নাঘর-পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
ঈশ্বর তােমার মঙ্গল করুন। ঈশ্বরের নিকট তােমার প্রসঙ্গে ইহাই আমাদের শেষ প্রার্থনা।
তােমার হতভাগিনী মা।
পুনশ্চ ঃ মা তােমার দুঃস্বপ্ন দেখা কি বন্ধ হয়েছে ?
লিলিয়ানের ধারণা চিঠির শেষের পুনশ্চ অংশটি মা’র লেখা। মা বাবাকে না জানিয়ে এই বাক্যটি লিখেছেন। কেন মায়েরা এত ভাল হয় ? কেন হয় ? সে নিজে কি কোন একদিন এমন একজন মা হবে?
লিলিয়ান কাঁদতে কাঁদতে ভাবল আমার প্রথম সন্তানটি যেন মেয়ে হয়। মেয়ে হলেই আমি মার নামে তার নাম রাখতে পারব।
ভিন দেশের ভিন ধর্মের একটি ছেলেকে বিয়ে করে ফেলার মত কাজ সাধারণত প্রচণ্ড ঝেকের মাথায় করা হয়, এবং ঝোক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই মনে হতে থাকে, কাজটা ঠিক হয় নি। খুব ভুল হয়ে গেছে। এদের বেলায় এটা ঘটল না। বিয়ের এক বছর পর এক গভীর রাতে লিলিয়ানের মনে হল, আমি নিশ্চয়ই আমার শৈশবে কিংবা আমার যৌবনে বড় ধরনের কোন পুণ্যকর্ম করেছি।
Read more