এখন একটু কঠিন কথা বলি— সুন্দরের সঙ্গে সব সময় দুঃখবােধ মেশানাে থাকে। মহান সৌন্দর্যের সঙ্গে বেদনাবােধ মেশানাে থাকতেই হবে। এডগার এলেন পাের এই কয়েকটা লাইন ব্যাপারটা সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে। খাতা খােল, এই কয়েকটা লাইন খাতায় লিখে নাও। তাঁর মতে সৌন্দর্য হচ্ছে
A feeling of sadness and longing …………..That is not akin to pain, And resembles sorrow only ………….As the mișt resembles the rain. তােমাদের প্রজেক্টগুলাে জমা নিয়ে আমি এখন তােমাদের ছুটি দিয়ে দেব। তােমাদের একটা হােম এসাইনমেন্ট আছে— সৌন্দর্য কী? এই নিয়ে এক পৃষ্ঠার একটা লেখা লিখবে। কোন মনীষী সৌন্দর্য সম্পর্কে কী বলেছেন এইসব কচকচানি না। তুমি কী ভাবছ সেটা লিখবে। ঠিক আছে ?
জ্বি ঠিক আছে। ………এখন আমি তােমাদের কাছে একটা পরীক্ষা দেব। এক এক করে তােমাদের সতেরাে জনের নমিই আমি বলব। আমি যখন বলেছিলাম তােমাদের সবার নাম আমি জানি তখন তােমরা সেটা বিশ্বাস করাে নি। প্রথমেই যদি আমার কথার ওপর বিশ্বাস না থাকে পরে আরাে থাকবে না। টিচার হিসেবে আমি যা বিশ্বাস করাতে চাইব তা বিশ্বাস করাতে পারব না।
মৃন্ময়ী-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
ফরিদা বলল, স্যার আপনার পরীক্ষা দিতে হবে না। আপনি ফেল করবেন, তখন আমাদের সবার খারাপ লাগবে। | আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমাদের নাম্বার বলতে শুরু করলেন। কোনাে ভুল হলাে না। সবাইকে খানিকটা চমকে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী রােল ফিফটিন ক্লাসের শেষে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে। তােমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
আমি হঠাৎ একটা ধাক্কার মতাে খেলাম। তবে সঙ্গে সঙ্গে মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। এই দ্রলােকের আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কারণটা স্পষ্ট না। তিনি কী বলতে চান সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা থাকলেও নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত রাখা যেত। আকাশ জোড়া মেঘ থাকলে ছাতা হাতে পথে নামতে হয়। সুন্দরবনে মধুর খোঁজে বাওয়ালীরা যখন ঢােকে তাদের সঙ্গে একজন থাকে গাদা বন্দুক নিয়ে। প্রস্তুতি থাকেই। শুধু আমার কোনাে প্রস্তুতি থাকবে না।
আমি লক্ষ করলাম ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা মুখে চাপা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আসগার আমার ডেস্কের কাছে এসে বলল, আমাদের নতুন স্যারের জন্যে একটা নাম পাওয়া গেছে। তোমার এপ্রােভেল পাওয়া গেলেই নামটা চালু করা যায়। ……..আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার এপ্রােবেলের প্রশ্ন আসছে কেন?
মৃন্ময়ী-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
তােমাকে উনি এপ্রােভ করেছেন বলেই তােমার এপ্রােভেলের প্রশ্ন আসছে। উনি নিজের নাম তাে Cow–sir লেখেন, ঐটাই বাংলা করে ‘গরু স্যার। উনার আপত্তি করার কিছু থাকল না। কি এপ্রােভ করছ তাে ?
আমি কিছু বললাম না, তবে মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম কাওসার নামের এই ভদ্রলােক অতি দ্রুত ‘গরু স্যার‘ হিসেবে পরিচিত হবেন। এমন একটা নামের ভার বহন করার মতাে শক্তি দ্রলােকের কি আছে? থাকার কথা না। বেশির ভাগ মানুষের মনের জোর তেমন থাকে না। ভদ্রলােকের অবস্থা ‘ছেড়ে দে ছাত্র সমাজ কেঁদে বাঁচি‘ হবার কথা।
স্যার আসব ? ……ভদ্রলােক তার ঘরে কম্পিউটারের কানেকশন জাতীয় কী করছিল। এখন চোখে চশমা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে ? ভাবটা এ রকম যেন আমাকে চিনতেই পারছেন না। আমি বললাম, স্যার আমি মৃন্ময়ী।
কিছু বলবে? …..আপনি বলেছিলেন ক্লাসের শেষে যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। আমি দেখা করতে এসেছি। ………ও আচ্ছা আচ্ছা । সরি ভুলে গিয়েছিলাম। এসাে। চেয়ারটায় বােস। ..আমি চেয়ারে বসলাম। আমার মেজাজ খারাপ লাগছে। দ্রলােক বেশ ভালাে করেই জানেন তিনি আমাকে আসতে বলেছেন। তারপরেও ভান করলেন। তাঁর মনে নেই। এই ভানটা করার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না।
মৃন্ময়ী তােমার কি বাড়িতে ফেরার খুব তাড়া আছে ? তাড়া থাকলে আজ চলে যাও। অন্য আরেকদিন কথা বলব– আমি পাের্ট লাইনের কানেকশনটা দিতে পারছি না। কানেকশন না দিতে পারা পর্যন্ত অন্য কোনাে দিকে মন দিতে পারছি না।
মৃন্ময়ী-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
আপনি কানেকশন দিন আমি অপেক্ষা করছি। কী জন্যে ডেকেছেন এটা না জানা পর্যন্ত আমার নিজের মধ্যেও এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করবে। …..অস্বস্তি কাজ করবে কেন? আজ আপনার সঙ্গে আমাদের প্রথম ক্লাস হলাে। ক্লাসের মাঝখানে বেশ
আয়ােজন করেই আপনি আমাকে বললেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। অস্বস্তির কারণটা এইখানেই। …তােমাদের এখানে কি এই নিয়ম যে কোনাে শিক্ষক তার ছাত্রকে দেখা করতে বলতে পারবে না ?
অবশ্যই বলতে পারবে। তবে তার জন্যে কারণ থাকতে হবে। ……গল্প করার জন্যে আমি কাউকে ডাকতে পারি না ? ছাত্র–ছাত্রীদের সঙ্গে কি একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করা যায় না? সব সময় দূরত্ব থাকতে হবে ? আমি নিয়ম ভাঙতে চাই।
নিয়ম ভাঙতে হলে শক্তি লাগে। সেই শক্তি কি আপনার আছে ? …………আমার ধারণা আছে। থাকলে তাে ভালােই। ক্লাসে আমার বক্তৃতা তােমার কেমন লাগল ? …….ভালাে। তবে আপনার প্রধান চেষ্টা ছিল আপনি যে অন্যদের চেয়ে আলাদা এটা প্রমাণ করা।
দের মতাে না? আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা ? …….আমি শান্ত গলায় বললাম, আমাদের ক্লাসে সতেরাে জন স্টুডেন্ট। এই সতেরাে জনের ভেতর থেকে আপনি আমাকে সিঙ্গেল আউট করে প্রশ্নগুলাে করছেন কেন ?
মৃন্ময়ী-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
কারণ তােমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। প্রথম দেখাতেই পছন্দের একটা কথা সমাজে প্রচলিত। ঐ ব্যাপারটাই ঘটেছে। তােমাকে আলাদা একটি মেয়ে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি হয়তাে অন্য আর দশজনের মতােই কিন্তু তুমি আমার ধারণা হয়েছে তােমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে আমার ভালাে লাগবে। এইজন্যেই তােমাকে খবর দিয়েছি। আমি যদি সমাজের আর দশজনের মতাে হতাম আমি আমার পছন্দের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতাম। অল্প অল্প করে তােমার সঙ্গে পরিচয় হতাে।
একদিন হয়তাে ডিজাইনের একটা বই তােমাকে পড়তে দিলাম। বই ফেরত দেবার সময় এক কাপ কফি খাওয়ালাম। টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে দিলাম যাতে ক্লাসের কোনাে বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে টেলিফোন করতে পারাে। তারপর একদিন তোমার টেলিফোন নাম্বার নিলাম। নানান ধাপ পার হয়ে আসা। আমি সবগুলি ধাপ এক সঙ্গে পার হতে চাই। তুমি আমার কথায় হার্ট হচ্ছ না তাে?
Read more